ঈদে মিলাদুন্নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন।
ঈদে মিলাদুন্নবী (দঃ) উৎযাপন
..................................................
—অধ্যক্ষ আল্লামা আলহাজ্ব মুহাম্মদ জালালুদ্দীন আল-কাদেরীঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) তিন শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। মুসলিম মিল্লাতের সুপ্ত সংস্কৃতির বিকাশে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ)-এর অনুষ্ঠান একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। ঈদ আরবি শব্দ। এটা আভিধানিক অর্থ একের পর এক, যা বার বার আসে। ইসলামী পরিভাষায় ওই দিনকে ঈদ বলা হয়, যাকে আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে কোনো নি’য়ামত বা অনুকম্পার পরিপ্রেক্ষিতে আনন্দের জন্যে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্তায়ালা কোরআন মজিদে সূরা ইউনুছ ৫৮ আয়াতে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে প্রতি বছর ঈদ ও পবিত্র আনন্দানুষ্ঠান পালনের কথা উল্লেখ করেছেন।
সূরা বাকারাতে হযরত মূসা (আঃ) ও বনী ইসরাঈলগণের নীল নদের পার হওয়া এবং প্রতি বছর এ উপলক্ষে আশুরার রোযা ও ঈদ পালন করা এবং সূরা মায়েদায় হযরত মূসা (আঃ) ও বণী ইসরাঈলের হাওয়ারীগণের আকাশ থেকে আল্লাহ্ কর্তৃক যিয়াফত হিসেবে মায়েদা অবতীর্ণ হওয়া উপলক্ষে প্রতি বছর ওই দিনকে ঈদের দিন হিসেবে পালন করার কথা কুরআনে উল্লেখ আছে। এরশাদ হচ্ছে_ মারয়াম তনয় ঈসা আরয করলেন, হে প্রতিপালক! আমাদের ওপর আকাশ থেকে একটা খাদ্য-খাঞ্চা অবতরণ করুন। যা আমাদের জন্যে ঈদ (আনন্দ আর উৎসব) হবে। আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্যে এবং আপনারই নিকট থেকে নিদর্শন এবং আমাদেরকে রিযিক দান করুন, আর আপনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা। [মায়েদা-১১৪] বনী ইসরাঈলের ওপর আল্লাহর রহমত নাযিলের স্মরণে যদি প্রতি বছর ওইদিনে ঈদ পালন করা যায়, তাহলে আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম নিআ’মত রাহমাতুলি্লল আলামীন (সাঃ)-এর শুভাগমন উপলক্ষে প্রতি বছর ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) পালন করা অধিক যুক্তিযুক্ত। হাদীসের সর্ববিশুদ্ধ কিতাব সহীহ বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবীজী (সাঃ)কে এক সাহাবী জিজ্ঞেস করেছিলেন- ইয়া রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ), প্রতি সোমবার আপনার রোযা রাখার কারণ কী? হুজুর পাক (সাঃ) উত্তরে ফরমালেন, এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এই দিনেই (সোমবার) ২৭ রমজান আমার ওপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। এটাও মিলাদুন্নবী (সাঃ) উদ্যাপনের উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
বর্ণিত আছে যে, হুজুর (সাঃ)-এর একজন পিতামহ হযরত কা’ব বিন লুওয়াই (রাঃ) প্রতি সপ্তাহের জুমার দিন মক্কার লোকদেরকে আল্লাহর ঘরের আঙ্গিনায় আহ্বান জানিয়ে জমায়েত করতেন। এই জুমআর নাম ছিলো পূর্বে আরোবা। তার ললাটে নূরে মোহাম্মদ (সাঃ) চমকিত। তিনি এই নূরে পাকের দিকে ইঙ্গিত করে জনগণকে নবী পাক (সাঃ)-এর আগমনের কথাও বলতেন এবং এই আরোবার নামকে পরিবর্তন করে জুমার নামকরণ করেন। যেহেতু তিনি নবী পাক (সাঃ)-এর শুভাগমন তথা ঈদে মিলাদের জন্যে লোকজনকে জমায়েত করতেন এবং নবীর আগমনের বাণী শুনাতে বিধায় ওই দিনের নাম জুম’আ হয়েছে। মূলত এই জুমআ’র দিনে সাপ্তাহিক হুযুর (সাঃ)-এর মিলাদ বর্ণনার দিবস ছিলো। ইসলামেও ওই দিনকে স্মরণ রাখার মানসে জুমআ’র নামাযকে সাপ্তাহিক ঈদ হিসেবে বাকী রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সাপ্তাহিক ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ)-এর দিন। যারা মিলাদুন্নবী (সাঃ) মেনে নিতে চায় না তাদের উচিত জুমআর নামায ছেড়ে দেয়া, কেননা এটা তো ঈদে মিলাদ দিবস, তাইতো জুমআর নামাজ হয়েছে। এটাই তো সৃষ্টির মূল ও আদি প্রিয় নবীজী (সাঃ)-এর পার্থিব জগতে শুভাগমনের পূর্বে মিলাদের ঘোষণা।
প্রিয় পাঠক! প্রিয় নবীজীর শুভাগমনের প্রাক্কালে বেহেশতী হুরগণ কীভাবে মিলাদ পালন করেছেন। আনোয়ারে মোহাম্মদী ও যুরকানী যথাক্রমে পৃষ্ঠা ২৩ ও ১১২ এ উদ্ধৃত আছে যে, হযরত আমেনা (রাঃ) বলেন, মহিলাদের ন্যায় আমার যখন প্রসব বেদনা শুরু হলো তখন আমি একটি বিকট আওয়াজ শুনলাম যার দরুণ আমার মধ্যে ভীতি সঞ্চারিত হলো। অতঃপর দেখলাম একটি ধূসর বর্ণ পাখির পালক আমার হৃদয়ে মালিশ করা হলো বা ছুঁয়ে দিলো। আমার সব ব্যথা বেদনা ও ভয়-ভীতি দূর হয়ে গেলো। এরপর আমার দৃষ্টি পড়লো যে, একটি পাত্রে সাদা শরবত আমার সামনে পেশ করা হলো। আমি ওই শরবত পান করলাম- যা ছিলো মধুর চেয়ে বেশি মিষ্টি। এরপর একটি নূরের আবরণ আমাকে ঢেকে ফেললো। আমি ওই নূরের বেষ্টনীতে অনেক সুন্দরী কন্যাদেরকে দেখতে পেলাম। যাদের গঠনাকৃতি ছিলো খেজুর গাছের ন্যায় দীর্ঘ এবং আকৃতিতে ছিলো আবদে মুনাফ কন্যাদের ন্যায়। তারা আমাকে তাদের অঙ্গনে নিয়ে গেলো। তখন আমি এই ভেবে আশ্চম্বিত হয়ে বললাম, হে সাহায্যকারিণী মহিলাগণ! আপনারা কোথা থেকে আসলেন এবং বেলাদতের সংবাদই বা কোথায় পেলেন? তখন তাদের একজন বললেন, আমি ফেরাউনের বিবি আছিয়া, অন্যজন বললেন, আমি ইমরান তনয় বিবি মরিয়ম। আর আমার সাথে এরা হলেন বেহেশতী হুর।
আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, হে মাহবুব আপনি ঘোষণা করুন, আল্লাহর ফযল ও রহমত পেয়ে (নবী করিম (সাঃ)কে) পেয়ে মুমিনরা যেনো অবশ্য আনন্দ উৎসব করে। কেননা এই আনন্দ প্রকাশ ও খুশি উদ্যাপন হচ্ছে তাদের যাবতীয় ধন-সম্পদ ও ইহকালীন পরকালীন জমাকৃত যাবতীয় বস্তু হতে উত্তম। [সূরা ইউনুস-আয়াত : ৫৮] তাফসীরে রুহুল মা’আনীতে উক্ত আয়াতে ফযল ও রহমত অর্থে মোহাম্মদ (সাঃ)-এর নাম উল্লেখ করেছেন। এটা হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর ব্যাখ্যা। রাসূল (সাঃ)-এর এক হাজার চারশত নামের মধ্যে ফযল, রহমত, বরকত, নেয়ামত, নূর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গুণবাচক নাম। আর আল্লাহ্ তায়ালা প্রদত্ত বান্দাদের প্রতি নিয়ামতসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো প্রিয় নবীজী (সাঃ)-এর সত্ত্বামোবারক যা পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। এরশাদ হচ্ছে- নিশ্চয়ই আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের ওপর যে, তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য হতে (মহান) রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের ওপর তাঁর আল্লাহর আয়াত সমূহ পাঠ করেন। তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিখান। [ আলে ইমরান-আয়াত : ১৬৪] সুতরাং নেয়ামত প্রাপ্তি উপলক্ষে শুকরিয়া আদায়ের জন্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করাই কুরআনের নির্দেশ। অতএব ঈদে মিলাদুন্নবী ও জশনে জুলুস কুরআনের আলোকেই প্রমাণিত।
হাদিসের আলোকে মিলাদুন্নবী (সাঃ) উদ্যাপন
সুহৃদ পাঠক! ইতোপূর্বে কুরআনুল করিমের আলোকে মিলাদুন্নবী (সাঃ) উদ্যাপনের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এখন হাদীসে পাকের আলোকে মিলাদুন্নবী উদ্যাপনের তাৎপর্য বিশ্লেষণ তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা হায়তামী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক রচিত ‘আননি ‘মাতুল কুবরা আলাল আলম’ গ্রন্থে মিলাদুন্নবী (সাঃ)-এর চমৎকার ফযিলত ও তাৎপর্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে। তৎমধ্যে কিয়দাংশ হলো-
* সাইয়্যেদুনা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী (সাঃ)-এর জন্যে একটি দেরহাম ব্যয় করবে সে বেহেশতে আমার সাথী হবে।’
* সৈয়্যিদুনা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী (সাঃ)-এর সম্মান দেবে, সে যেনো দ্বীন ইসলামকেই জীবিত রাখবে।
* ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান বিন আফফান (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী (সাঃ) -এর জন্য একটি দিরহাম খরচ করবে সে যেনো নবীজী (সাঃ)কে তাযিম করবে এবং মিলাদ পাঠ করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে, সে ঈমানের সাথেই দুনিয়া হতে বিদায় নেবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সুবহানাল্লাহ)
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু আমের আনসারী (রাঃ) অত্যন্ত প্রেম, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা সহকারে নবীজী (সাঃ)-এর মিলাদুন্নবী পালন করতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু দারদা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটি পেশ করা যায়। তিনি বলেন, আমি একদিন নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে মদিনাবাসী আবু আমের (রাঃ) গৃহে গমন করে দেখতে পেলাম তিনি তার সন্তানাদি ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে একত্রিত করে নবী করিম (সাঃ)-এর পবিত্র বেলাদত সম্পর্কিত জন্ম বিবরণী শিক্ষা দিচ্ছেন এবং বলেছেন যে, আজই সেই পবিত্র জন্ম তারিখ। এই মাহফিল দেখে নবী করিম (সাঃ) খুশি হয়ে তাকে সুসংবাদ দিলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা তোমার জন্যে মিলাদের কারণে রহমতের অসংখ্য দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতাগণ তোমাদের সকলেরই জন্যে মাগফিরাত কামনা করেছেন। [সাবিলুল হুদা ও আত-তানভীর] শাফায়াতে মোস্তফাই পরকালীন মহান প্রাপ্তিও বড়ই নিয়ামত। এমন নিয়ামতও মহানবীজী (সাঃ)-এর মিলাদ পালনে লাভ করা যায়। এ প্রসঙ্গে মুফাসসিরকুল শিরোমণি হযরত আবদুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদিস প্রণিধানযোগ্য। একদিন তিনি নিজ গৃহে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন। তিনি উপস্থিত সাহাবীগণের নিকট নবী করিম (সাঃ)-এর পবিত্র বেলাদত সম্পর্কিত ঘটনাবলী বয়ান করেছিলেন। শ্রোতামণ্ডলী শুনতে শুনতে মিলাদুন্নবী (সাঃ)-এর আনন্দ উপভোগ করছিলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা ও নবীজীর দরুদ পড়ছিলেন। এমন সময় নবী করিম (সাঃ) সেখানে উপস্থিত হয়ে এরশাদ করলেন, তোমাদের সকলের প্রতি আমার সুপারিশ- শাফায়াত অবধারিত হয়ে গেলো। (সুবহানাল্লাহ) [ আদদুররুল মুনায্যাম] শীর্ষ স্থানীয় তাবেঈন, তব’য়ে তাবেঈন ও ইসলামী চিন্তাবিদকের অভিমত ঃ
প্রিয় পাঠক! এখন সাহাবী পরবতী যুগে মিলাদুন্নবী (সাঃ) সম্পর্কে কি অভিমত-অভিপ্রায় সেই দিকে আপনাদের দৃষ্টি নিবন্ধন করার প্রয়াস পাচ্ছি।
১. হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন, আমার যদি ওহুদ পাহাড়ের পরিমাণ স্বর্ণ থাকতো তাহলে আমি মিলাদ শরীফ পাঠ করার জন্যে সব স্বর্ণ খরচ করে দেওয়াই পছন্দ করতাম।
২. প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সম্রাট হযরত জুনাইদ বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, যে ব্যক্তি মিলাদুন্নবী (সাঃ) মাহফিলে উপস্থিত হয়ে তার প্রতি নবীজী (সাঃ) সম্মান প্রদর্শন করবেন সে ব্যক্তি ঈমানের ক্ষেত্রে সফল হবে।
৩. ইমাম শাফেয়ী (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি মিলাদ মাহফিল ভাই-বন্ধুদের একত্রিত করবে, খানাপিনার ব্যবস্থা করবে, মিলাদ শরীফের জন্যে দৃষ্টিনন্দন মঞ্চ তৈরি করবে, উত্তম আমল করবে এবং মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা হবে, আল্লাহ্ তায়ালা তাকে সিদ্দীকীন, শোহাদা ও বুযুর্গানে দ্বীনের সাথে হাশর নসীব করবেন এবং সে ব্যক্তি জান্নাতুল নাঈমে বাস করবে।
৪. ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহঃ) তাঁর লিখিত ‘ওয়াসায়েল ফি শরহে শামায়েল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, যে ঘরে যে মসজিদে কিংবা যে মহল্লায় মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান করা হয়, আল্লাহর ফেরেশতাগণ সে ঘর, সে মসজিদ, ও সে মহল্লায় বেষ্টন করে ওই স্থানের লোকদের ওপর রহমত বর্ষণ করে থাকে। আর আল্লাহ্ তায়ালা আ’মভাবে তাদেরকে রহমত ও সন্তুষ্টি দান করেন। আর জিব্রাঈল, মীকাঈল, ইসলাফিল ও আযরাঈল (আঃ)-এর উদ্যোক্তাদের ওপর রহমত বর্ষণ করতে থাকেন।
সুদূর অতীতকালে কীভাবে মুসলমানগণ ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) পালন করতেন তার একটি চমৎকার বক্তব্য আল্লামা শাহবুদ্দিন কুস্তুলানী (রহঃ) মাওয়াহেবে লুদুনিয়া কিতাবে বিধৃত করেছেন। মিলাদুন্নবী (সাঃ) সমর্থক বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম ও ফকীহগণ নিজ নিজ গ্রন্থে দলিল হিসেবে আল্লামা কুস্তুলানী (রাঃ)-এর এই দুর্লভ প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন।
মাওয়াহেবের উক্ত উক্তির অনুবাদ পাঠক সমীপে পেশ করলাম। ‘সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সুদূর অতীতকাল থেকে নবী করিম (সাঃ)-এর পবিত্র বেলাদত উপলক্ষে মাসব্যাপী সর্বদা মিলাদ মাহফিল উদ্যাপন করতেন। যিয়াফত প্রস্তুত করে তারা লোকদের খাওয়াতেন। মাসব্যাপী দিনগুলোতে বিভিন্ন রকমের সদকা খয়রাত করতেন এবং শরীয়ত সম্মত আনন্দ উৎসব করতেন। তারা পূর্ণমাস শান-শওকতের সাথে মাহফিল অনুষ্ঠান করতেন- যার বরকতে বরাবরই তাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ প্রকাশ পেতো। মিলাদ মাহফিলের বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে এটা একটি পরীক্ষিত বিষয় যে, মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের বরকতে এ বছর আল্লাহর পক্ষ হতে নিরাপত্তা কায়েম থাকে এবং ত্বরিৎগতিতে তা মনোবাঞ্ছা পূরণের শুভ সংবাদ নিয়ে আসে। অতএব, যিনি বা যারা মিলাদুন্নবী মাসের প্রতিটি রাতকে ঈদের রাতে পরিণত করে রাখবে তাদের ওপর আল্লাহর খাস রহমত বর্ষিত হবে।’ [ মাওয়াহেবে লুদুনিয়া, মা ছাবাতা বিচ্ছুন্নাহ] এ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মিলাদুন্নবী (সাঃ)-এর উদ্যাপন ও আয়োজনে বান্দার রিযিকে প্রাচুর্যতা ঘটে। কেননা, আল্লাহ্ তায়ালার নি’আমতের চর্চা ও বিকাশ করলে তিনি শুভরকারীদের নি’আমতে অধিক প্রসার ঘটান। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছে, যদি তোমরা আমার নি’আমতের শোকর জ্ঞাপন কর তাহলে আমি তোমাদের নি’আমত আরো বৃদ্ধি করবো। [সূরা ইব্রাহীম-আয়াত : ৭] প্রিয় নবীজী (সাঃ)-এর শুভ বেলাদতে শুধু মুসলিম-নবী প্রেমিকরা লাভবান হন তা নয়, বরং অমুসলিম কট্টর কাফিররাও এর ফুয়ুযাত ও বরকত থেকে বঞ্চিত হয় না। এ প্রসঙ্গে আমরা আবু লাহাবের দাসী ছুয়াইবা আযাদ হওয়ার ঘটনার অবতারণা করতে পারি। প্রিয় নবীজী (সাঃ) এ ধরাধামে ভূমিষ্ট হওয়ার পর ছুয়াইবা নাম্মী এক দাসী তার ভাতিজার জন্ম সংবাদ এ খুশিয়ে হয়ে আপন দাসী ছোয়াবাকে আযাদ করে দেয়। ৫৫ বছর পর বদরের যুদ্ধের ৭ দিন পর প্লেগ রোগে আবু লাহাবের মৃতু্য হয়। আবু লাহাবের ভাই হযরত আব্বাব (রাঃ) স্বপ্নে আবু লাহাবকে দেখে নবী দুশমনির পরিণতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আবু লাহাব আফসোস করে বললো, আমার স্থান নরকে হয়েছে। তবে ভাতিজা নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্ম সংবাদে খুশি হয়ে দাসীকে শাহাদাত আঙ্গুলীর ইশারায় আযাদ করার কারণে প্রতি সোমবার আমার কবরের আযাজ হালকা হয় এবং শাহাদাত আঙ্গুলী চুষে কিছুটা তৃষ্ণা নিবারণ করি। (সুবহানাল্লাহ) [সূত্র : বোখারী শরীফ ও মাওয়াহেব] এই শুভ সংবাদে দুটি উপকারিতা অর্জিত হলো। এক. ছুয়াইবা দাসত্বের বন্ধন হতে মুক্তি পেলো। দুই. আবু লাহাবের সোমবারের শাস্তি হালকা হলো।
সংস্কৃতির বিকাশে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) উদ্যাপন :
বর্তমানে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) উদ্যাপন সুন্দর ও সুরুচিপূর্ণ ইসলামী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে নিঃসন্দেহে। এ মিলাদ উদ্যাপনে যখন জমায়েত ও সমাবেশ হয়, র্যালি ও পদযাত্রায় মুখরিত হয় তখন তা বিশেষভাবে প্রভাবিত করে নবীপ্রেমিক প্রেম-ঢেউকে। এটিই আধুনিক মুসলিম সুশীল সমাজে জশনে জুলুসে মিলাদুন্নবী (সাঃ) নামে পরিচিতি লাভ করে। আমাদের মাঝে সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে ভিন্ন আমেজের, ভিন্ন আবহের বিচিত্র উপলক্ষে সমাহার রয়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, সমপ্রদায়গত চেতনার বহুবিধ উপলক্ষকে ঘিরে যার যার রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আনুষ্ঠানিক বৈচিত্র্যে জাতীয় ও রাষ্ট্রদিবস উদ্যাপন, নেতা-নেত্রীর জন্মদিন বা মৃতু্যবার্ষিকী পালনে ভৌগলিক ভাষাগত ঐতিহ্যের ও নানা প্রতিফলন দেখা যায়। বিভিন্ন দলের বা সংস্থার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনও হয়ে থাকে। সৃষ্টির উৎস, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, সৃষ্টির কেন্দ্র, আলোর প্রথম উদ্ভাস ও সিরাজুম মুনিরা পৃথিবীতে আগমন দিবসই পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ)-এর মূল উপলক্ষ। এ উপলক্ষের চেয়ে সুন্দর, উত্তম ও শ্রেষ্ঠ কোনো উপলক্ষ নেই নিঃসন্দেহে। এ উপলক্ষে গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে কোথাও কোনো অকল্যাণ ও অসুন্দরের নূ্যনতম ইঙ্গিতও নেই। সর্বস্তরের মুসলিম লোক এ মিলাদুন্নবী (সাঃ) মাহফিলের মাধ্যমে নবীর আদর্শ চর্চা ও অনুশীলন করার সুযোগ পায়। বর্তমানে পাশ্চাত্য, ভারতীয় ও বিজাতীয় সংস্কৃতি মুসলিম সমাজকে দারুণভাবে কলুষিত করেছে। ইসলামী আদর্শের স্থলে স্থান করে নিয়েছে এসব কুরুচি ও অশ্লীল সংস্কৃতি। তবে এসব উপলক্ষ ও সংস্কৃতিতে নেই কোনো মুক্তি ও নাজাতের গ্যারান্টি। বিশ্বনবী (সাঃ)-এর অনুপম ও অনন্য আদর্শই একমাত্র ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে। তার আদর্শ ও চরিত্রই সর্বোত্তম, শ্রেষ্ঠত্ব ও অনন্যতার মূর্ত প্রতীক। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছে ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) মধ্যে রয়েছে সুন্দর আদর্শ।’
জশনে জুলুস সংস্কারে আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহঃ)-এর অবদান :
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন প্রত্যেক শতাব্দীতেই এক বা একাধিক সংস্কারক ওলী প্রেরণ করেন। যারা দিশাহারা মানব গোষ্ঠীকে দ্বীনের সঠিক পথ ও মত প্রদর্শন সহ দ্বীনী কল্যাণার্থে এমন কিছু সংস্কারধর্মী গ্রহণ করেন, যা পরবর্তী উম্মতে মোহাম্মদী (সাঃ) এর আকীদা ও আমলের ক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লবের সুচনা হয়। প্রিয় নবীজী (সাঃ) এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্তায়ালা এ উম্মতের জন্যে প্রতি শতাব্দীর শুরুতে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন, যিনি এ দ্বীনকে উম্মতের জন্যে সংস্কার করেন। (আবু দাউদ) এ সংস্কারক ইসলামে মুজাদ্দিদ নামে পরিচিতি। যেখানে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অনুপস্থিত হয়ে যায় এবং এর ফলে মানুষ কুশিক্ষা পেয়ে প্রকৃত শিক্ষা অনুপস্থিত হয়ে যায়। যেখানে প্রকৃত সুন্নী মতাদর্শভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন, ওয়াজ-নসিহত, হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা ভাষণের মাধ্যমে সৎকাজের ব্যবস্থার আদেশ ও অসৎকাজের বাধা দান বিশেষত ইসলামী আদর্শের অনুশীলনে গুরুত্বারোপ করা এসব মহৎ ব্যক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞ ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় জানা যায়, ইসলামের প্রথম মুজাদ্দিদ হলেন হযরত ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহঃ), যার সংস্কার নীতির মাধ্যমে ইসলামের বাতিল ফিরকা খারেজি, মু’তাযিলা, রাফেজী গং উৎখাত হয়ে প্রিয় নবীজি (সাঃ)-এর বিশুদ্ধ হাদীস গোটা মুসলিম জাতির কাছে পেঁৗছে গেছে। মুজাদ্দিদ’র এ ধারাবাহিকতায় ১৫তম স্থানে সমাসীন হন আওয়াদে রাসূল আল্লামা সৈয়দ আহম্মদ শাহ সিরিকোটি (রহঃ)-এর একমাত্র সুযোগ্য পুত্র সন্তান আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহঃ)। তিনি শ্রদ্ধেয় আব্বাজান সৈয়দ আহমদ শাহ (রহঃ)-এর আদর্শে গড়ে ওঠে কুরআন হাদীসের সঠিক রূপরেখায় অনেক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়ে তাতে পূর্ণ সফলতা অর্জন করেছেন। এসব সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে অন্যতম হলো জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ)।
১৯৭৪ সাল। স্বাধীনতোত্তর কালে বাংলাদেশে তিনি তখনো তাশরিফ আনেননি। পাকিস্তানের সিরিকোট শরীফ থেকে চট্টগ্রামে আনজুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুনি্নয়া কর্মকর্তাদের চিঠি মারফত নির্দেশ দিলেন- ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) উদ্যাপন উপলক্ষে জশনে জুলুস-এর আয়োজন করতে। উল্লেখ্য যে, এ চিঠিতে জশনে জুলুস কি এবং কীভাবে পালন করা হবে; এর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও জানিয়ে দিয়েছেন। ১৯৭৪ ইংরেজি সালে বালুয়ার দীঘি পাড়ের খানক্বাহ-এ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়বিয়া হতে আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ সওদাগর আল কাদেরী (সাঃ) নেতৃত্বে সেদিন জুলুস চট্টগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করে জামেয়া আহমদিয়া সুনি্নয়া ময়দান শেষ হয়ে এক বিশাল ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) মাহফিল-এর যে রূপ ধারণ করেছিলো তা চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশে এক নতুন ঈমানী চেতনা সৃষ্টি করেছিলো। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরবর্তী পর্যায়ে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) উদ্যাপিত হয়ে আসছে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬ ইংরেজি পর্যন্ত মোট দশ বছর যাবৎ হুজুর কেবলা নিজেই বাংলাদেশে জুলুসের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সেদিন থেকে বাতিলরাতো এর বিরোধিতা করে আসছে। আবার প্রথম দিকে সুন্নী মাশায়েখের কিছু কিছু অনুগ্রহ দেখালেও পরবর্তী পর্যায়ে তারা এ কাজটি নির্দ্ধিধায় গ্রহণ করেন। এটা হুজুর কেবলার অন্যতম কারামত। এখন বহু সুন্নী মাশায়েখ দরবারের উদ্যোগে জশনে জুলুসের আয়োজন করা হয়। জশনে জুলুসের বাংলা অর্থ হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, স্বাগত মিছিল ইত্যাদি। এ সংস্কার আজ সার্বজনীন হয়ে উঠেছে এবং এটি একটি স্বীকৃতি ইসলামী কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। এটি নবীপ্রেমের মাতোয়ারাদের মহামিলন কেন্দ্র। বাংলাদেশে এ কৃতিত্বের প্রথম ও প্রধান দাবিদার এ শতাব্দীর মহান সংস্কারক গাউছে যমান আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহঃ)। ১২ রবিউল আউয়াল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন নগর, শহর, বন্দর, গ্রামে জুলুসের যে ঢল নামে তা দেখে রীতিমতো ইসলামের শত্রুদের ভিত কেঁপে ওঠে। ফলে কিছু নাস্তিক ইতোমধ্যে জশনে জুলুসবিরোধী বিকৃত বক্তব্য দিয়ে হলেও মনের জ্বালা মেটাতে থাকে। অথচ প্রতি বছর জুলুসে পরিধি বাড়ছেই। ইসলামী ঐক্য ও সংহতি জোরদার হচ্ছে। আজ এ জুলুস উপমহাদেশে একটি ধর্মীয় সংস্কৃতি ও মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) এ শতাব্দীর এক শ্রেষ্ঠ দ্বীনী সংস্কার। বর্তমানে তারই যোগ্য উত্তরসুরি জামেয়ার পৃষ্ঠপোষক গাউছে জামান আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (রহঃ) এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম নগরীতে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় আনজুমান এ রাহমানিয়া আহমদিয়া সুনি্নয়ার উদ্যোগে ১২ রবিউল আউয়াল চট্টগ্রাম এ জশনে জুলুস উদ্যাপিত হয়ে আসছে। আজ এ জুলুস বিশ্বের বৃহত্তম জুলুসে রূপ ধারণ করছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল বিশ্বে যেখানে মানুষ মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যেখানে সন্ত্রাস ব্যাপক আকার ধারণ করছে, দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধবিগ্রহ চলছে, নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে, যেখানে আন্তঃধর্মীয় সমপ্রতি ও সৌহার্দ্য বিনষ্ট হচ্ছে, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতপার্থক্য ও আচার আচরণের ভিন্নতা সহ্য করা হচ্ছে না সেখানে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর অনুপম আদর্শ ও সর্বজনীন শিক্ষা অনুসরণই সমগ্র বিশ্বে ও বিভিন্ন সমাজে প্রত্যাশিত শান্তি ও সমপ্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) আমাদের সবার মনে সহনশীলতা, সংযম, হৃদ্যতা, সমপ্রীতি, পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা সৃষ্টিতে সহায়ক হোক। আমিন বিহুরমাতি সাইয়্যিতুল মোরসালিন।
আলহামদুলিল্লাহ।
ReplyDeleteআলহামদুলিল্লাহ
ReplyDelete