ওমাইর ইবনে সাদ রাঃ এর একটি ঘটনা।
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের পাশের নগরী হিমস। এই নগরে যাকেই গভর্নর করা হউক না কেন, নাগরিকদের অভিযোগের অন্ত থাকে না! কিছুদিনের মধ্যেই খলিফার কাছে তারা আবেদন জানায়ঃ এই লোকের চেয়ে ভালো একজন গভর্নর নিয়োগ দিন!
বিরক্ত খলিফা হযরত ওমর ফারুক রাঃ হন্যে হয়ে একজন যোগ্য গভর্নর খুজঁতে শুরু করলেন। কে আছে এমন ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতেই পারে না?
উমাইর ইবনে সাদ রাঃ নিয়োগ পেলেন হিমস নগরীর গভর্নর পদে। তখন তিনি শাম দেশে নিয়োজিত ছিলেন জিহাদের সেনাপতি হিসেবে। তিনি ছিলেন মহানবী সাঃ এর স্নেহধন্য একজন সাহাবী। আদেশ পেয়েই ছুটলেন নতুন কর্মস্থলে...
এক বছর হয়ে গেলো এরমধ্যে হিমস থেকে কোন অভিযোগ এলো না! গভর্নর কোন চিঠিও লিখলেন না খলিফাকে আবার কোন রাজস্বও এলো না!
আশ্চর্যান্বিত খলিফা জরুরী পত্র দিয়ে ডেকে পাঠালেন গভর্নর উমাইর ইবনে সাদ রাঃ কে।
পত্র পাওয়া মাত্র তৈরী হয়ে গেলেন! নিত্য ব্যবহারের ব্যাগে ওজুর পাত্র আর খাবারের প্লেট ঢুকিয়ে হাঁটা শুরু করেন মদিনার দিকে।
ইতিমধ্যে চুল দাড়ি বড় হয়ে গেলো মদিনায় পৌছাতে গিয়ে! অবিরাম পথ চলায় ক্লান্ত শ্রান্ত এই বিধ্বস্ত গভর্নর কে দেখে খলিফা তাকে বসতে দিয়ে জানতে চাইলেনঃ
: এই অবস্থা কেন তোমার?
: কই আমার তো কিছুই হয় নি। আমি বেশ আছি। বরং সাথে নিয়ে এসেছি আমার গোটা দুনিয়া।
: কি আছে তোমার দুনিয়ায়?
: আমার ব্যাগে আছে পানি পান ও ওজু করার জন্য পাত্র, গোসলের বালতি, খাবার প্লেট আর পানির মশক। এটাই আমার দুনিয়া। এই কটা দ্রব্য ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না।
: তুমি কি হেঁটে এসেছো?
: জ্বী, আমিরুল মোমেনিন।
: প্রশাসনের পক্ষ থেকে কি তোমাকে ঘোড়া দেয়া হয়নি?
: বর্তমান প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি আর আমিও চাই নি।
: বাইতুল মালের রাজস্ব পাঠাওনি কেন?
: যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে কর নিয়ে আসতো, তাদের সাথে কথা বলে সেই অঞ্চলের অভাব অভিযোগ এবং অতি দরিদ্রদের তালিকা করে সেখানেই তাদের সাহায্য ও অঞ্চলসমূহের উন্নয়ননের জন্য খরচ করেছি। রাজধানীতে পাঠানোর মতো অবশিষ্ট থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাঠিয়ে দিতাম।
স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্বের যথাযথ ব্যবহারের নতুন পদ্ধতি জেনে খলিফা ভীষণ খুশি হলেন এবং তাকে পুনরায় স্বপদে যোগ দিতে বললেন। কিন্ত উমাইর ইবনে সাদ রাঃ বিনয়ের সাথে গভর্নর পদ ফিরিয়ে দিয়ে মদিনা উপকন্ঠে নিজের পরিবারের সাথে বসবাস করতে চাইলেন। খলিফা সেই আবেদন মঞ্জুর কররেল।
খলিফা ওমর ফারুক রাঃ কিছুদিন পর উমাইর ইবনে সাদ রাঃ এর প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার জন্য রাষ্ট্রের বিশ্বস্ত একজন গোয়েন্দা হারেস কে পাঠালেন। ১০০ দিনারের একটি থলে দিয়ে বললেনঃ যদি তার আর্থিক অবস্থা সত্যিই শোচনীয় হয় তবে নিজের পরিচয় জানিয়ে আমার সালাম দিয়ে এই থলেটি তাকে উপহার দিয়ে এসো।
খলিফার গোয়েন্দা স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে একদিন পৌঁছে গেলেন উমাইর ইবনে সাদ রাঃ এর দরোজায়। পরিচয় গোপন করে মুসাফির হয়ে তার আতিথ্য প্রার্থনা করলেন। উমাইর ইবনে সাদ রাঃ ছদ্দবেশী গোয়েন্দাকে সাদরে বরণ করে নিলেন আর তিন দিন রাতে খেতে দিলেন শুধু একটি করে পাতলা যবের রুটি!
চতুর্থ দিন একজন প্রতিবেশী সেই গোয়েন্দা হারেস কে নিজের বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণের অনুরোধ জানালেন। হারেস কৌতুহলের বশে জানতে চাইলে বললেনঃ আপনার উপস্থিতিতে উমাইর ইবনে সাদ রাঃ ভীষণ বিপদে পড়ে গেছেন। আপনাকে আপ্যায়ন করতে গিয়ে উনি সস্ত্রীক গত তিনদিন শুধু পানি খেয়ে আছেন, তা না হলে তারা প্রতি রাতে একটি পাতলা যবের রুটি ভাগ করে খেতেন...
গোয়েন্দা হারেস অবশেষে নিজের পরিচয় জানিয়ে খলিফা ওমর রাঃ র পক্ষ থেকে সালাম সহ সেই থলে তার হাতে তুলে দিলেন। উমাইর ইবনে সাদ রাঃ বিনয়ের সাথে সেই উপহার ফিরিয়ে দিতে চাইলে সব শুনে ভেতর থেকে উনার স্ত্রী বললেনঃ উপহার ফিরিয়ে দিবেন না। বরং এই অঞ্চলে যারা দরিদ্র তাদের মধ্যে ভাগ করে দিন। স্বামী স্ত্রী দুই চোখ এক করলেন না সেই অর্থ বিতরন শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
গোয়েন্দা হারেস খলিফার কাছে তুলে ধরলেন তার অভিজ্ঞতা। খলিফা আবার ডেকে পাঠালেন উমাইর ইবনে সাদ রাঃ কে। তিনিও কালবিলম্ব না করে ছুটলেন খলিফার দরবারে...
খলিফা তাকে কাছে বসিয়ে জানতে চাইলেনঃ
: আমার পাঠানো দিনারগুলো দিয়ে কি করেছো?
: মুদ্রাগুলো যখন আমাকে দিয়েই দিয়েছেন, তখন আর জেনে কি হবে?
: আমি অনুরোধ করছি, বলো কি করেছো?
: নিজের (সম্ভবত আখেরাত বোঝাতে চেয়েছেন) জন্য সঞ্চয় করে রেখেছি, যেদিন সন্তান ও সম্পদ কোন কাজে আসবে না...
হযরত ওমর ফারুক রাঃ কাঁদতে কাঁদতে বললেনঃ আমি ঘোষণা দিচ্ছি যে তুমি সেইসকল মহান ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত, যারা নিজেরা অভাবী হওয়া সত্বেও অন্যদের নিজেদের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
তিনি উমাইর ইবনে সাদ রাঃ কে ৬০ সা ( এক সা হলো তিন কেজি তিনশত গ্রাম) খাবার আর এক জোড়া পোশাক উপহার দিলেন।
উমাইর ইবনে সাদ রাঃ খাবার ফিরিয়ে দিলেন প্রয়োজন নেই জানিয়ে! তবে একটি পোশাক গ্রহণ করলেন এই বলেঃ আমার স্ত্রীর জন্য নিচ্ছি, কারণ তার পোশাক ছিঁড়ে বিবস্ত্র প্রায়...
::
লেখকের নাম পেলে দিতাম। পাইনি। কাজেই সংগৃহীত বলতে হচ্ছে। লেখাটা পড়ে আশ্চর্য হয়ে ভাবছি, আমরা কীসের জন্য ভোগ বিলাসের জীবন খুঁজি? একজন উমাইর ইবনে সাদ রাঃ র জীবনী আমাকে লজ্জিত করে তুলেছে। আসুন আমাদের যা আছে, যতটুকু আছে, অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার সুখ খুঁজি।
Comments
Post a Comment