ঈদে মিলাদুন্নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন করব?

মিলাদ অর্থ জন্ম। ঈদে মিলাদুন্নাবি অর্থ রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিন উপলক্ষে খুশি উদযাপন করা। তাঁর জন্মবিত্যান্ত আলোচনা করা।
ঈদে মিলাদুন্নাবি পালন করা ফরয বা ওয়াজিব নয় কিন্তু মুস্তাহাব কাজ। পালন করাটা উত্তম, না করলে গুনাহ নেই। তবে বিরোধিতা করা গুমরাহির অন্তর্ভুক্ত।
.
আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, আজ যেভাবে র‍্যালী- মিলাদ মাহফিল করে মিলাদুন্নাবী পালন হচ্ছে সেভাবে মিলাদুন্নাবি পালন তো স্বয়ং রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা তাঁর সাহাবীরাও করেননি। যেই কাজ রাসুলের সাহাবীরাই করেননি আমরা কিভাবে সে কাজ করতে পারি? আমরা কি রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহাবীদের চেয়েও বেশী ভালোবাসি??
.
এর উত্তরে এটাই বলবো যে, ক্বুরয়ান হাদিসে এমন কোনো আয়াত নেই যেখানে আল্লাহ বা রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, হে আমার বান্দা বা উম্মতেরা তোমরা এমন কোনো কাজ করো না যা আমি বা আমার সাহাবা করেননি। বরং ইসলামে নতুন সৃষ্ট ভালো কাজকে সর্বদাই উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবাগন বিদয়াতে হাসানা পছন্দ করেছেন।
.
উমার রাঃ যখন নিয়মিত ভাবে তারাবীর নামায জামাত সহকারে পড়া আরম্ভ করলেন, (দেখুন বুখারী শরীফ, তারাবিহ অধ্যায় ১৮৮৩ নং হাদিস) তখনতো কোনো সাহাবি উমার রাঃ কে এ প্রশ্ন করেননি যে, হে উমার যে কাজ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিতভাবে করেননি তাহলে আপনি কেনো নিয়মিতভাবে করছেন? আপনি কি দ্বীন রাসুলের চেয়ে বেশি বুঝেন?
কোনো সাহাবীই উমার রাঃ কে এ প্রশ্ন করেননি, কেননা তারা জানতেন এ কাজ উত্তম, এ বিদয়াত ভালো, এ নব্যসৃষ্টি ভালো। তাইতো উমার রাঃ একে "নে'মাতু বিদয়াতিল হাযিহি" অর্থাৎ উত্তম বিদআত বলে আখ্যায়িত করেছেন। (দেখুন বুখারী তারাবীহ অধ্যায়)
.
এভাবেই আপনি যখন শরীয়ত মেনে মিলাদুন্নাবি পালন করবেন, তখন কেউ আপনাকে নবী করেননি, সাহাবী করেননি বলে প্রশ্ন করলে তাকে উপরোক্ত হাদিস দ্বারা বুঝিয়ে দিন যে, নবি করেননি, সাহাবী করেননি তাই একাজ করা যাবেনা একথা ঠিক নয়। বরং নবীজী যা নিষেধ করেছেন তা করা ঠিক নয়। আল্লাহ সুরা হাশরের ৭ নং আয়াতে একথাই উল্লেখ করেছেন।
মিলাদুন্নাবিতে মিসিল, মিলাদ মাহফিল করাটা সুন্নাত নয়, কিন্তু এটা মুস্তাহাব, তথা ভালো কাজ।
.
আল্লাহ সুরা আম্বিয়ার ১০৭নং আয়াতে এরশাদ করেন অর্থঃ "আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।" আল্লাহ এখানে রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সমগ্র জাহানের জন্য রহমত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আবার সূরা ইউনুস:৫৮ এ আল্লাহ এরশাদ করেন - "আপনি বলে দিন, তারা যেনো আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত প্রাপ্তিতে খুশি উদযাপন করে। এ (খুশি ও আনন্দ উদযাপন) তাদের সমুদয় সঞ্চয় থেকে উত্তম।" সুবহানআল্লাহ।
.
১ম আয়াতে আল্লাহ রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাহমাত বলছেন এবং ২য় আয়াতে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন এই রাহমাত (অর্থাৎ রাসুলকে) পেয়ে খুশি উদযাপন করতে। শুধু উদযাপনই নয় বরং এই খুশি উদযাপন করাটা তাদের সমস্ত সঞ্চয় (আমল) থেকে উত্তম বলে স্বয়ং আল্লাহ ঘোষনা দিয়েছেন। রাইসুল মুফাসসিরিন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ সহ অনেক মুফাসসিরীন এ বিষয়ে একমত যে, উক্ত আয়াতে বর্ণিত 'ফাদল' (অনুগ্রহ) ও 'রাহমাত' দ্বারা রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। এছাড়াও বুখারী শরীফে ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত রয়েছে যে,"মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নি'মাত।" (বুখারী ২/৫৬৬)।
.
সূরা আল ইমরান:১৬৪ - "আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন।" এখানেও আল্লাহ বোঝাতে চাচ্ছেন যে রাসুলকে প্রেরন করে তিনি মুমিনদের উপর অনেক বড় এহসান করেছেন, তাই এই নেয়ামত পাওয়ার জন্য তাদের খুশি উদযাপন করা উচিৎ।
সূরা আল বাক্বারাহ:২৩১ -"আল্লাহর নির্দেশকে হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করো না। আল্লাহর সে অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যা তোমাদের উপর রয়েছে ।" এখানেও আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ তথা নবিজীর কথা স্বরন করার আদেশ দিয়েছেন।
.
এছাড়াও পবিত্র কোরআনের আলোকে জানা যায়, আল্লাহর নে'মাত প্রাপ্তিতে খুশি উদযাপন করা নবীদেরই সুন্নাত। যেমন ঈসা (আঃ) যখন আল্লাহর দরবারে নিজ উম্মতের জন্যে খাদ্য চেয়েছিলেন, তখন এভাবে আরজ করলেন, সূরা মায়েদা-১১৪ অর্থঃ "হে আল্লাহ আমাদের রব! আসমান থেকে আমাদের জন্যে নেয়ামতের খানা অবতীর্ণ করুন, যা আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্যে ঈদ হয়ে যায়।" কোরআনের এ আয়াতে ঈসা আঃ এ আশাই ব্যক্ত করেছেন যে, যেদিন আল্লাহপাকের নেয়ামত অবতীর্ন হবে, সেদিনটি ঈদ হিসেবে পালিত হোক পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল উম্মতের জন্য; যা ওই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের একটি উত্তম পন্থা।
ঈসা আঃ যদি সামান্য জান্নাতি খাবার পেয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারেন তাহলে আমরা রাহমাতুল্লিল আলামিনকে (যাকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ কিছুই সৃষ্টি করতেননা) পেয়ে কেনো ঈদ উদযাপন করতে পারবো না? তাঁর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কি আছে বা হতে পারে বা কখনও হবে? বরং এদিন ঈদ মানানো ঈসা আঃ এর ঈদ মানানোর চেয়ে কোটিগুন উত্তম। তাই মিলাদুন্নাবি পালন করা কুরয়ান হতে প্রমাণিত, আলহামদুলিল্লাহ
.
রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি নিজের মিলাদ নিজেই পালন করেছেন?
হ্যাঁ, তিনি করেছেন। কেননা হযরত আবু কাতাদা (রা) হতে বর্ণিত, একজন সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে আরজ করলেন "ইয়া রাসুলাল্লাহ আমার মাতা পিতা আপনার কদমে কুরবান হোক। আপনি প্রতি সোমবার রোজা পালন করেন কেনো?
জবাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এই দিনে আমি জন্মগ্রহন করেছি এবং এই দিনেই আমার উপর ওহী নাজিল হয়েছে। (সহীহ মুসলিম শরীফ ২য় খন্ড, ৮১৯ পৃষ্ঠা, বায়হাকী: সুনানে কুবরা, ৪র্থ খন্ড ২৮৬ পৃ: মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল ৫ম খন্ড ২৯৭ পৃ: মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৪র্থ খন্ড ২৯৬পৃ: হিলয়াতুল আউলিয়া ৯ম খন্ড ৫২ পৃ:)।
দেখুন রাসুল স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছরে নয় বরং প্রতি সপ্তাহে নিজের জন্মদিন পালন করেছেন। তাহলে আমাদের প্রতি বছরে উদযাপন করাটা কোন ভিত্তিতে অবৈধ হতে পারে?
.
রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেয়ে খুশি হওয়ার ফলাফলঃ হযরত আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন, আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখি। সে আমাকে বলে "কবরের জিন্দেগীতে আমি শান্তিতে নেই। কিন্তু হ্যাঁ, প্রত্যেক সোমবার তর্জনী আঙ্গুল থেকে আমি মিস্টি পানি পেয়ে থাকি কেননা আমি ছুয়াইবা নামক বাদীকে (নবীজীর মিলাদের সংবাদ দেয়ায় খুশী হয়ে) আযাদ করেছিলাম এ আঙ্গুলের ইশারায়। "(সহিহ বুখারী কিতাবুন নিকাহ-৫১০১নং হাদিস)। এই ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে হজরত আব্বাস রাঃ বলেন আবু লাহাবের এই সোমবারের শাস্তি লাঘবের কারণ রাসুল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের খবর আবু লাহাবকে দিলে সে খুশি হয়ে সুয়াইবাকে (খবরকারী দাসী) আজাদ করেছিল। (ফাতহুল বারি সরহে সহীহুল বুখারী ,৯ম খন্ড,১১৮ পৃষ্ঠা, ইমাম ইবনে হাজার আসক্বালানী)।
.
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল আবু লাহাবের মত কাফের যার ধ্বংস হওয়ার ব্যপারে কুরয়ানে সুরা নাযিল হয়েছে, যার স্থান সর্বদাই জাহান্নাম, সে যদি নবীজির জন্মদিনের সংবাদে খুশি হয়ে মাত্র একটি দাসী আযাদ করলে প্রতি সোমবার জাহান্নামে আল্লাহ তাকে পানি দান করেন, তাহলে আমরা যারা মুমিন সুন্নি মুসলমান, নবি প্রেমিক তারা মিলাদুন্নাবি পালন করলে আল্লাহ কি আমাদের উত্তম প্রতিদান দিবেন না? ইন শা আল্লাহ অবশ্যই দিবেন, কেননা তিনিই বলেছেন নবিকে পেয়ে খুশি উদযাপন করা সকল সঞ্চয়কৃত আমলের চেয়ে উত্তম (সুরা ইউনুস ৫৮)। আলহামদুলিল্লাহ।
.
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন, একদা তিনি উনার গৃহে সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মবিত্যান্ত আলোচনা করছিলেন। শ্রবনকারীরাও তা শুনে আনন্দ পাচ্ছিলেন।
ঠিক ওই সময় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন, তোমাদের জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেছে "। এই হাদিসটি বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে এসেছে। যেমনঃ মাওলুদুল কবীর, আত তানভীর ফী মাওলিদিল বাশীর ওয়ান নাযার, হকিকতে মোহাম্মদী (মিলাদ অধ্যায়), দুররুল মুনাজ্জাম, ইশবাউল কালাম।
.
নবিজীকে পেয়ে যে জাশনে জুলুস বা খুশি হয়ে মিসিল বা র‍্যালী করা তাও কিন্তু নতুন কিছু নয়। বরং এটাও সাহাবীদের সুন্নত। মুসলিম শরীফের ২য় খণ্ডের ৪১৯ পৃষ্ঠায় হাদিসে বর্ণিত আছে "রাসূল স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিন হিজরত করে মদিনা শরীফে আগমন করেছেন ওইদিন মদিনাবাসী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সাহাবীগন রাসূল স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের শুকরিয়া হিসেবে আনন্দ মিছিল করেছিলেন এবং তালায়াল বাদরু আলাইনা..... এই নাত পাঠ করেছিলেন। কেউ কেউ বাড়ির ছাদের উপর আরোহন করেছিলেন, আবার অনেকে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন এবং 'ইয়া রাসূলাল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্লোগান দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন।" হ্যা, এটাইতো আমরাও করে থাকি, সাহাবিদের দেখানো পথে হেটে, তাঁদের সুন্নতের উপর আমল করে। আলহামদুলিল্লাহ।
.
এছাড়াও উমার রাঃ এর ইসলাম গ্রহনের প্রসিদ্ধ ঘটনা যা আমরা সকলেই জানি এবং যা ইবনে ইসহাক্বের সিরাহ সহ অসংখ্য সিরাতের কিতাবে পেয়ে থাকি যে, উমার রাঃ ইসলাম গ্রহন করলে সাহাবিগন রাসুলে আরাবি স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আবেদন জানান যে তারা ইসলামের সুমহান বানী ও উমার রাঃ এর মুসলমান হওয়ার কথা পুরো মক্কায় প্রকাশ্যে ছড়িয়ে দিতে চান মিসিলের মাধ্যমে (কেননা উমার রাঃ এর মুসলমান হওয়ার আগে ইসলাম প্রচার চুপি চুপি করে করা হত, কুফফারে মক্কার অত্যাচারের ভয়ে)। রাসুল স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের অনুমতি দিলে তাঁরা ৪০ জন সাহাবি একে অপরের হাত ধরে মক্কার অলিগলিতে লাইলাহা ইল্লাল্লাহ স্লোগান দিয়ে মিসিল করেছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ। সাহাবিগন উমারকে রাঃ পেয়ে খুশিতে মিসিল করতে পারলে আমরা কি উমার রাঃ এর নবি, সমস্ত নবিদের সরদার, শাফায়াতের কান্ডারী, আমাদের ঈমান-জান কে পেয়ে খুশিতে মিসিল করতে পারিনা?
.
এটা অত্যান্ত দুঃখের বিষয় যে কিছু পথভ্রষ্টদের ঈমান এতই দুর্বল হয়ে গিয়েছে যে আজ তারা নিজের পরিবারের বা অন্য কারো জন্মদিন বিধর্মীদের নিয়মে (গানবাজনা, নাচ যা সম্পুর্ন ইসলাম বিরোধী) পালন করলে তাদের বিবেক তাদের বাধা দেয়না, তখন তারা কুরয়ান-হাদিসে এর বৈধতা খোজে না। কিন্তু যখনিই কোনো নবি প্রেমিক মুমিন রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেয়ে কুরআন ও শরিয়ত মোতাবেক (মিলাদুন্নাবিতে কুরআন-হাদিস পাঠ, নবিজীর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ, নবিজীর আলোচনা যা আল্লাহ পুরো কুরয়ান জুড়ে করেছেন, সাহাবিদের সুন্নতের অনুসরণ করে জাশনে জুলুস করা, অবশেষে মুনাজাত করা হয়। আপনিই বলুন এখানে কোন কাজটি ইসলাম বিরোধী? একটিও পাবেন না, বরং সবই কুরয়ান হাদিস মতে উত্তম কাজ) রাসুল স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিন পালন করে তখন কিছু অবুঝের ঈমান/বিবেক কুরয়ান হাদিস খুজে!!! ধিৎকার এমন বিবেকে যা ইসলাম, আল্লাহ ও রাসুল স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মানুষকে দুরে রাখে। এটা ঈমান নয় বরং এটা শয়তান। কেননা আমরা পড়েছি ইবন কাসির এর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২য় খন্ড, ১৬৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছেঃ যখন রাহমাতুল্লিল আলামিনের জন্ম হলো তখন ইবলিস খুবই কেঁদেছিল ও দুঃখিত হয়েছিল। তাই আজ মিলাদুন্নাবিতে কারো মন যদি ব্যথিত হয়, তাহলে সেই বিবেচনা করুক তার ঈমান কোন দিকে যাচ্ছে এবং কাকে অনুসরণ করছে? রাহমানকে নাকি শয়তানকে!!!
.
কিছু স্বল্পজ্ঞানী বলে থাকে যে এদিনই রাসুল স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াফাতও করেছেন, তাই আমাদের শোক পালন করা উচিত!! তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি যে হাদিসে এসেছে নবীগন কবরে জীবিত ও তারা নামাযরত। দেখুন মুসলিম শরীফ খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ১৮৪৫ হাদীস নং ২৩৭৫, ইবনে মাযাহ শরীফ খন্ড: ২ পৃষ্ঠা ২৯১ হাদীস নং ১৬৩৭, মুসনাদে আবু ইয়ালা খন্ড:৩ পৃষ্ঠা৩৭৯ হাদীস নং ৩৪১২ (সহীহ) হাইছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ খন্ড ৮ পৃষ্ঠা ২১১।
এছাড়াও সহিহ হাদিসমতে আপনি সাধারণ কোনো মানুষের জন্যও তিন দিনের বেশি শোক পালন করতে পারবেননা। (সহীহ বুখারি- ৩০৭ ই. ফা.)। তাইতো রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য শোক পালন আজ পর্যন্ত কেউ করেননি। এছাড়াও রাসুল স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন "আমার জীবন তোমাদের জন্য কল্যানকর এবং আমার ওয়াফাত ও তোমাদের জন্য কল্যানকর।" (শিফা শরীফ কৃত কাজী আয়াজ খন্ড২ পৃ১৯, খাসায়েসুল কুবরা কৃত ঈমাম সুয়ুতী খন্ড২ পৃ২৮১)।
.
অবাক লাগে যখন শুনি কিছু অবুঝ মিলাদুন্নাবির র‍্যালীকে জন্মাষ্টমীর মিসিলের সাথে তুলনা দেয়; কেউ কেউ তো এতোদুর বলে ফেলে যে, মিলাদুন্নাবীর র‍্যালী নাকি জন্মাষ্টমীর অনুকরণে করা হয়!!! মুসলমানেরা হিন্দুদের অনুকরনে নাবীজির জন্মদিন পালন করে!!! নাউজুবিল্লাহ
এই সমস্ত মুর্খদের বলবো দয়া করে ইতিহাস সম্পর্কে পড়ুন, ইতিহাস জানুন; যে কোনটি কতসালে পালন করা শুরু হয়। সর্বজনস্বীকৃত মত হলো রাষ্ট্রিয়ভাবে প্রথম ঈদে মিলাদুন্নবীর পালন শুরু করেন আরবের অধিপতি বাদশাহ মালিক মুজাফফর উদ্দিন কৌকুরী, ৬০৪ হিজরীতে তথা ১১৭৪ খ্রিস্টাব্দে আর জন্মাষ্টমী পালন শুরু হয় ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে (সময় হলে উইকিপিডিয়া দেখুন, নিজেই সত্যতা যাচাই করুন)। এর অর্থ হলো মিলাদুন্নাবি পালনের কমপক্ষে ৪০০ বছর পর হিন্দুরা মুসলিমদের অনুকরণে তাদের ধর্মগুরুর জন্মদিন পালন শুরু করেছে। মুসলমানেরা বিধর্মীদের অনুকরণ করেনি বরং বিধর্মীরা মুসলমানদের অনুকরন করেছে, আলহামদুলিল্লাহ।
.
মিলাদুন্নাবীর মাসে আরেকভাবে ফিৎনা ছড়ানো হচ্ছে একথা বলে যে, রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মতারিখের নাকি ঠিক নেই!! অথচ জন্মতারিখের কয়েকটি হাদিস বিদ্যমান রয়েছে। যেখানে হযরত আফফান রাঃ হতে বর্নিত, হযরত জাবির ও হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, "রাসুলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম হস্তি বাহিনী বর্ষের ১২ই রবীউল আউয়াল সোমবার হয়েছিল।" (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা; বুলূগুল আমানী ফী শরহিল ফাততিহর রব্বানী' ২য় খণ্ড, ১৮৯ পৃঃ বৈরুতে মুদ্রিত; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ' ২য় খণ্ড, ২৬০ পৃঃ বৈরুতে মুদ্রিত)।
.
এছাড়াও ৫৬টি মুসলিম দেশের মধ্যে ৫১টি দেশই (স্বয়ং সৌদিআরব এর অন্তর্ভুক্ত) ১২ই রবিউল আউয়াল রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষনা করেছে; তাই মুসলিম উম্মাহ যে এ বিষয়ে একমত তা প্রমানে এ তথ্য যথেষ্ট। (একমত না হলে একেক দেশ একেক দিনে পালন করতো নয় কি?)
এরপরেও যদি কারো ১২ই রবিউল আউয়াল রাসুলের জন্মদিন অবিশ্বাস হয়, তাহলে তারা যেদিন বিশ্বাস করে, সেদিনই মিলাদুন্নাবি পালন করুক; কেননা আমরা চাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সর্বাধিক গুণগান হোক, তা যেদিনই বা যেখানেই হোক না কেনো; আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের নিকট ১২ তারিখ সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য তাই আমরা ১২ তারিখ করি, আপনার নিকট যে তারিখ গ্রহনযোগ্য মনে হয় আপনি সেই তারিখে করুন কারোও বিরোধিতা না করে।
.
হাজার বছর ধরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দ্বারা উদযাপিত মহান দিন ঈদে মিলাদুন্নাবিকে ৫০/১০০ বছরের আগের কোনো লেখকের বইয়ের মাধ্যমে আপনি হারাম বিদআত বলতে পারেননা। ঈদে মিলাদুন্নাবি পালন যদি আসলেই বিদআত /হারাম/ অনৈসলামিক হতো তাহলে ৫৬টি মুসলিম দেশের মধ্যে ৫১টি দেশই এদিনে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষনা করতো কেনো? কেনো এ আইন বানানোর সময় সেদেশের প্রকৃত মুসলমানেরা!! এর বিরুদ্ধাচার করলোনা?
এগুলিই কি প্রমান করেনা ঈদে মিলাদুন্নাবি পালন মুসলিম উম্মাহর স্বীকৃত খারাপ বিদআত নয় বরং একটি উত্তম আমল?
.
কিছু অবুঝেরা বলে থাকে যে ইসলামে ঈদ নাকি শুধু দুটোই, ঈদুল ফিতর ও আযহা!!! আসলেই কি তাই? হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয় এ দিন (জুমুআর দিন) আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি জুময়া পড়তে আসবে সে যেন গোসল করে ও সুগন্ধি থাকলে উহা লাগায় এবং তোমাদের উপর মিসওয়াক করা আবশ্যক। [ইবন মাজাহ পৃঃ ৭৮]। অনেক রেওয়াতে ৯ই জিলহজ্ব অর্থাৎ আরাফার দিনটিকেও ঈদের দিন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। [দেখুনঃ – মিশকাত শরীফ পৃঃ ১২১ ও তিরমিযী শরীফ পৃঃ ১৩৪]।
সুতরাং একথা বলা যে ঈদ শুধু দুটোই স্বল্পজ্ঞান বা মুর্খতা ছাড়া কিছুই নয়।
.
৯ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতী (রঃ) মিলাদুন্নাবী এর পক্ষে উনার রচিত স্বীয় কিতাব হুসনুল মাক্বাসিদ ফি আ'মালিল মোলিদ ৬৫ পৃঃ, হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রাঃ তাঁর ফায়সালায়ে হাফ্ত মাসায়েলে মিলাদুন্নবি পালন সম্পর্কে উত্তম কথা বলেছেন। এছাড়াও ইবনে তাইমিয়া (যাকে সমস্ত বাতেলেরা নিজের ইমাম মনে করে) (১২৬৩খৃঃ - ১৩২৮খৃঃ) তার কিতাব “ইক্তিদায়ে সিরাতে মুস্তাকীম ৩১৩" পৃস্টায় লিখেছে, ”যদি মিলাদ মাহফিল নবী স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি ভালবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য করা হয়ে থাকে তবে আল্লাহ এ মুহাব্বত ও সম্মান প্রদর্শনের কারণে সওয়াব বা প্রতিদান দেবেন।”
.
একই কিতাবের ৩১৫ পৃস্টায় সে লিখেছে, “বরং ঐ দিনে (রাসুল স্বাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মদিনে) পরিপূর্ণরূপে অনুষ্ঠান করা এবং এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, উত্তম নিয়ত এবং হুজুরে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি মুহাব্বত প্রদর্শন বড় প্রতিদানের কারন হবে।”
এছাড়াও অসংখ্য ইমাম,মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুজাদ্দিদ ও হক্কানী আলেমগন মিলাদুন্নাবী পালন করেছেন যার বর্ননা জগতবিখ্যাত কিতাব আন নে'য়মাতুল কুবরা আ'লাল আ'লাম এ বিস্তারিতভাবে রয়েছে।
.
অপরপক্ষে মিলাদুন্নাবি পালন হারাম বা নাজায়েজ হওয়ার কথা কুরআন-সহিহ হাদিসতো দূরের কথা বরং দ্বয়ীফ হাদিসেও নেই। 
আসল কথা বলতে পথভ্রষ্টরা সাধারণ মুসলমানদের বিপথগামী করতে জন্মদিবস ঠিক নেই, বিদাত, নাবী সাহাবি পালন করেননি, শোক দিবস পালন করা উচিৎ, এটা বিধর্মী সভ্যতা ইত্যাদি ভিত্তিহীন কথা বলে থাকে। আর আশিক্বে রাসুলের জন্য তো এটুকু দলীলই যথেষ্ট যে এদিনে তার প্রিয়তম হাবীব দুনিয়ায় তাশরিফ এনেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।

আল্লাহ আমাদের ঈমানকে ছদ্মবেশী বাতেলদের হাত থেকে রক্ষা করে সিরাতে মুস্তাক্বিমে চলে এই মহান দিবসকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করার তওফিক দান করুন।

Comments

Popular posts from this blog

ছবছে আওলা ও আ'লা হামারা নবী।

পিডিএফ বই ২৮ টি একত্রে।

খাজা গরীবে নেওয়াজ এর জিবনী।