যে কারণে ফতোয়ায়ে রজভিয়ার বিরোধীতা।

যেসব কারণে ফতওয়ায়ে রযবিয়্যাহ-'র বিরোধিতা :
- কাজী মুহাম্মাদ আবু-সাঈদ সাগে-আল-মাদানী।

ফতওয়া (فتوى‎)। আরবি শব্দ। এর বহুবচন ফাতাওয়া فتاوى‎)। যার অর্থ- 'বিধান বা সমাধান।' যা কোনো ঘটনা বা অবস্থার প্রেক্ষিতে ইসলামি শরিয়তের দলিলের আলোকে অভিজ্ঞ মুফতি বা ইসলামি আইন-বিশেষজ্ঞ প্রদান করে থাকেন। যখন কোন ব্যক্তি সরাসরি কুরআন ও হাদিস কিংবা ফিকহের আলোকে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান বের করতে অপারগ হন, তখন তিনি মুফতির কাছে এই বিষয়ের সমাধান চান। এটিকে ইসতিফতা (اِسْتِفْتَاء) বলা হয়। মুফতি তখন ইসলামি শরিয়তের আলোকে সমস্যাটির সমাধান জানিয়ে দেন। এই সমাধান প্রদান করাকেই ইফতা (إِفْتَاء ) এবং প্রদত্ত সমাধান বা বিধানটিকে ফতওয়া (فتوى‎) বলা হয়।

ফতওয়া দেয়ার অধিকার সকলের জন্য অবারিত বা উন্মুক্ত নয় বরং যিনি ফকিহ বা মুফতি কেবল তিনিই ফতওয়া দেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। ফতওয়া বিভাগের সনদপ্রাপ্ত আলেম ছাড়া যে কোন কেউ ফতওয়া দিতে পারবেন না, এটা কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী ও বেআইনী। এবং এতে ফেৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি ও সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়।  মুফতি বা ফকিহ না হলে জাতীয় মসজিদের খতিবও ফতওয়া দিতে পারেন না, অথবা যে কোন পির যত বড় বুজুর্গই হোন না কেন তিনিও ফতওয়া জারি করেন না।

ফতওয়ার উৎস ৪টি- (ক) কুরআন, (খ) সুন্নাহ, (গ) ইজমা এবং (ঘ) কিয়াস। এগুলো বাদ দিয়ে ফতওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না। আর একজন মুফতির যে সকল গুণাবলী এবং বৈশিষ্ট্য থাকলে ফতওয়া দেয়ার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয় তা হল তিনি প্রথম হবেন একজন ফকিহ অর্থাৎ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ধর্মীয় জ্ঞান, ধর্মীয় আইন ইত্যাদি বিষয়ে অভিজ্ঞ। সুতরাং যিনি ফতওয়া দিতে পারেন তিনি হবেন- (ক) বুদ্ধিমান, (খ) জ্ঞানী, (গ) ধর্মতত্ত্ববিদ, (ঘ) ধর্মীয় আইনজ্ঞ, (ঙ) ন্যায়-অন্যায়, হালাল-হারাম প্রভৃতি বিষয়ে সুক্ষ বিচারক, (চ) ইসলামী আইনের বিস্তারিত ব্যবহারবিধি সম্পর্কে অভিজ্ঞ। যিনি এসকল গুণের বা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নন তিনি ফকিহ বা মুফতি নন এবং তার ফতওয়া গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না।

সর্বপ্রথম ফতওয়া দিয়েছেন সুমহান আল্লাহ তায়ালা আহকামুল হাকিমিন। তাঁর পরে তাঁর প্রিয়তম হাবিব (ﷺ) ফতওয়া দিয়েছেন। তিনি দীর্ঘ তেইশ বছর। তিনি সকল সমস্যার সমাধান দিতেন। তাঁর পবিত্র যুগে হজরত মুয়াজ বিন জাবাল রদিয়াল্ল-হু তায়ালা আনহুও ফতওয়া দিতেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। রসুল (ﷺ) আড়াল হবার পর খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে যখন নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হতে লাগল তখন এর দায়িত্ব অর্পিত হলো সাহাবাগণের উপর বিশেষ করে যারা কুরআনে হাফেজ ছিলেন, তাঁদের উপর এ দায়িত্ব অর্পিত হয়। এ পর্যন্ত যে সব সাহাবাগণের ফতওয়া পাওয়া যায়, তাঁদের সংখ্যা একশত ত্রিশ। তাঁদের মধ্যে সাতজনের ফতওয়া সবচাইতে বেশি। তাঁরা হচ্ছেন- হজরত উমর ফারুক রদিয়াল্ল-হু তায়ালা আনহু, হজরত মওলা আলি রদিয়াল্ল-হু তায়ালা আনহু, হজরত আব্দল্লাহ ইবনে মাসউদ রদিয়াল্ল-হু তায়ালা আনহু, উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রদিয়াল্ল-হু তায়ালা আনহা, হজরত যায়েদ ইবনে সাবিত রদিয়াল্ল-হু তায়ালা আনহু, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদিয়াল্ল-হু তায়ালা আনহু ও হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদিয়াল্ল-হু তায়ালা আনহু। এভাবে ফতওয়ার ব্যবহার মুসলিম সমাজে আজ পর্যন্ত আছে এবং ভবিষতেও থাকবে।

বিশ্বে এখন অসংখ্য ফতওয়া গ্রন্থ পাওয়া যায়। যেমন- ফতওয়ায়ে শামি, ফতওয়ায়ে তাতার খানিয়া, ফতওয়ায়ে ফয়জুর রসুল, ফতওয়ায়ে আলমগিরি, মাজমাউল ফতওয়া, ফতওয়ায়ে রযবিয়্যাহ ইত্যাদি। এছাড়াও বাজারে আরও কিছু ফতওয়া গ্রন্থ পাওয়া যায়, যেগুলো ইমান বিনষ্ট করে। যথা : ফতওয়ায়ে রশিদিয়্যাহ, ফতওয়ায়ে মাহমুদিয়্যাহ, ফতওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ, ফতওয়ায়ে মুনতাখাব, ফতওয়ায়ে আল বানী, ফতওয়ায়ে ফকিহে মিল্লাতসহ আরও অনেকগুলো ফতওয়া রয়েছে, যেগুলো ভুলে ভরা। এবং উপরোল্লিখিত ফতওয়ার বইগুলো কুফরি, শিরক ও ভ্রান্ত আকিদায় ভরপুর।

এবার আসুন, মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। ফতওয়া রযবিয়্যাহ হলো একটি যুগোপযোগী ফতওয়া গ্রন্থ। এই গ্রন্থ অসংখ্য ফতওয়া রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে বাতিল ফিরকা, ভণ্ড পির ও ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন, তাদের আরোপিত ভ্রান্ত যুক্তির খণ্ডন এবং ইমান বিনষ্টকারী আকিদার মূলোৎপাটনসহ নানা ধরনের আপত্তিসমূহ চিরতরে দাফন করা হয়েছে। এই কিতাব আজকে অনেকের কাছে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এই কিতাবের কারণে বাতিলদের লোকসান হচ্ছে। ওরা মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে পারছেনা, ভণ্ড পিরেরা মহিলাদের নিয়ে উরশের নামে নাচানাচি করতে পারছেনা, ধর্মব্যবসায়ীরাও পারছেনা নিশ্চিন্তে ধর্মব্যবসা করতে। তাই আজ এই গ্রন্থের বিরোধিতায় মেতে উঠেছে হাজারো কপাল পোড়া অভাগা।

আগেই বলা হয়েছে, ফতওয়া প্রদান করেন তিনিই, যার মধ্যে উপরোল্লিখিত ৬ টি শর্ত পাওয়া যায়। এবার দেখবো ফতওয়া রযবিয়্যাহ-'র লেখক কে? এর লেখক হলেন জলিলুল কদর মুজাদ্দিদ, ওয়াল মুজতাহিদ, ইমামে আহলে সুন্নত, হামিয়ে সুন্নত, মাহিয়ে বিদআত, আলা হজরত ইমাম আহমাদ রেজা খান ফাজেলে বেরলভি আলাইহির রহমাতুর রহমান৷ মাত্র তের বৎসর দশ মাস পাঁচ দিন বয়সের মধ্যে তিনি সকল প্রকার জ্ঞান লাভ করেন এবং ওইদিনই নিজ পিতা রইসুল মুতাকাল্লিমিন হজরত আল্লামা মাওলানা মুফতি নকি আলি খান আলাইহির রহমাতুর রহমান-এঁর সহযোগিতায় তাঁর জীবনের সর্বপ্রথম ফতওয়া দিয়েছিলেন। সেই ফতওয়াটি ছিল এই- যদি নাক দিয়ে কোনও বাচ্চার পেটে কোনও মহিলার দুগ্ধ প্রবেশ করে, তাহলে ঐ মহিলা উক্ত বাচ্চার দুধ মা হবে কিনা? আলা হজরত উত্তর প্রদান করেন, যেকোনো স্ত্রী লোকের দুগ্ধ মুখ কিংবা নাক দ্বারা বাচ্চার পেটে প্রবেশ করলে সে স্ত্রীলোক দুধ মা প্রমাণিত হবে এবং হুরমাতে রেজায়তের হুকুম লাঘব হবে। অর্থাৎ, ঐ স্ত্রীলোককে বিবাহ তার জন্য হারাম হবে। বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার এইযে, যেদিন তিনি মুফতি পদে অধিষ্ঠিত হন ওই দিনই আলা হজরতের উপর নামাজ ফরজ হয়েছিল।

ফতওয়ায়ে রযবিয়্যাহ হলো এ যুগের একটি শ্রেষ্ঠতম ফতওয়া গ্রন্থ। ত্রিশ খণ্ডে ছাপা হয়েছে। এতে মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা বাইশ হাজার। অর্থাৎ, এ পিঠ ও পিঠ মিলিয়ে চুয়াল্লিশ হাজার পৃষ্ঠা। এটা গুজব নয়, সত্য। প্রমাণ চাইলে চলে যান মুন্সীগঞ্জের পশ্চিম দেওভোগে। ওখানে দাওয়াতে ইসলামী কর্তৃক পরিচালিত একটি মাদরাসা আছে। নাম জামেয়াতুল মদিনা। ওই মাদরাসার লাইব্রেরিতে এই 'ফতওয়ায়ে রযবিয়্যাহ' সংরক্ষিত আছে। চাইলে গিয়ে একটু পড়ে আসতে পারেন। যদি যোগ্যতা থাকে। হ্যাঁ, এই ফতওয়া পড়তে পারার জন্য আগে যোগ্যতা দরকার। যোগ্যতা ছাড়া এটা পাঠ করতে পারার সৌভাগ্য অর্জিত হয় না। যোগ্যতা হচ্ছে প্রিয় নবি সল্লাল্ল-হু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এঁর ইশক। এই যোগ্যতা ছাড়া এই ফতওয়ার মর্মার্থ বোঝা সম্ভব নয়।

এই ফতওয়াতে আকিদা বিষয়ক যেসব প্রশ্নের জবাব প্রদান করা হয়েছে, তা হচ্ছে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের প্রকৃত আকিদা। ফিকহের জগতেও এটি এক উচ্চমার্গের কিতাব। শুধু ফিকহ শাস্ত্রের উপর এত বড় কিতাব তাঁর পূর্বে আর কেউ লিখেছে বলে এরকম কোনো নজির নাই। নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, কোরবানি, ইতিকাফ, পর্দা, পানি, মিসওয়াক, দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, পির-মুরিদি, মাজার, মান্নত, ব্যাংকিং, ব্যবসা, নালাইন শরিফের সঠিক পরিমাপ- এতে কী নাই? এরকম হাজারো মাসআলার সঠিক সমাধান রয়েছে এতে। এই কিতাবের সূচিপত্রও একটি খণ্ডের আকার ধারণ করেছে। আল্ল-হু আকবার!

আমার লেখাটির মূল প্রসঙ্গ হচ্ছে এই- বাতিলেরা কোন কোন কারণে ফতওয়ায়ে রযবিয়্যাহ-'র বিরোধিতা করে?

উত্তর :

ফতওয়ায়ে রযবিয়্যাহ-তে আকাইদ, পির-মুরিদি, ইমামত, পর্দা,  মাজারসহ একরকম অসংখ্য বিষয়ের নির্ভুল ও চূড়ান্ত সমাধান পাওয়া যায়। একারণেই এই ফতওয়ার গ্রন্থটি এখন বাতিলের কাছে অসহ্যকর। ইদানিং কিছু মাল্লামা মৌ-লোভীরা এই কিতাবটির বিরুদ্ধে নানা আপত্তি ও অপবাদও ছড়াচ্ছে। এই কিতাবে মহিলাদেরকে পর্দা করার কথা বলা হয়েছে, ততটুকুই; যতটুকু করার কথা প্রিয় নবি সল্লাল্ল-হু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। এই কিতাবে ভণ্ড পিরের অনুসরণ না করার কথা বলা হয়েছে, এই কিতাবে মহিলাদেরকে মাজারে গমনে বাধা দেওয়া হয়েছে। এই কিতাবে তাজিমি সিজদা এবং তাজিয়া মিছিল করাকেও হারাম বলা হয়েছে ও ঢোল-বাজনার বিরুদ্ধেও লেখা হয়েছে।

সাহাবায়ে কেরামের সমালোচকদের কঠোর জবাবও বর্ণিত হয়েছে এই কিতাবে। ও মুফতি সাহেবেরা, উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোর সমাধান কি তাই নয়, যা আলা হজরত দিয়েছেন? এসব সহ্য করতে না পেরে আজ সেই আলা হজরত সম্পর্কেই নিন্দা ছড়াচ্ছ, যিনি হক ও বাতিলের স্পষ্ট সীমারেখা টেনে দিয়েছেন? সুমহান আল্লাহ পাক তোমাদের সমস্ত কুমতলব ভেস্তে দিবেন। কেননা, সত্যের বিজয় সবসময়। এই বিজয়কে রুখে দেওয়ার মতো ক্ষমতা বা দুঃসাহস আজও পর্যন্ত কেউ পায়নি। ভবিষ্যতেও পাবে না। যারাই আমার আকা আলা হজরতের বিরুদ্ধে মাত্র একটি বর্ণ লিখবে, তারা শেষ বয়সে হয় রেজভি হবে; নয়তো ইমানহারা হয়ে মরবে। এটাই চিরন্তন ও ভবিষ্যতের ঘটিতব্য সত্য।

Comments

Popular posts from this blog

ছবছে আওলা ও আ'লা হামারা নবী।

খাজা গরীবে নেওয়াজ এর জিবনী।

পিডিএফ বই ২৮ টি একত্রে।