ইসলামের মূলধারা ও বাতিল ফিরকা।পর্ব-১।
১ম পর্ব।
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর, যিনি মানবজাতির সার্বিক কল্যাণের বিধান হিসেবে দ্বীন-এ-ইসলামকে মনোনীত করেছেন। দরুদ-সালাম জানাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের মূর্তপ্রতীক সাইয়্যেদুল মুরসালীন হুযুর পুরনুর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, যিনি ইসলামের সঠিক রূপরেখা অনুসরণের প্রতি উম্মতকে আদেশ প্রদান করেছেন এবং ভ্রান্তদলসমূহ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক সত্যের মাপকাঠি হিদায়াতের উজ্জ্বল নক্ষত্র সাহাবা কেরাম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমের উপর, যাঁরা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথ ও মত অনুসরণ করে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টির সনদ লাভ করেছেন। তাবেইন, তবই-তাবেইন, আইমায়ে মুজতাহেদীন, মুফাসসেরীন, মুহাদ্দেসীন, ফোকাহা, তরীকতের ইমাম, আউলিয়া কেরাম, সুন্নী ওলামাপীর-মাশায়েখদের উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত বর্ষিত হোক, যাঁরা অদ্যাবধি দ্বীন ইসলাম'-এর সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উপর অটল থেকে যুগে যুগে ইসলামের মুখোশধারী বাতিল দল-উপদলের ভ্রান্তিকে চিহ্নিত করে মুসলিম উম্মাহকে গোমরাহীর হাত থেকে রক্ষা করেছেন। নবীকুল শিরোমনি হযুর পুরনুর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেসালের পর মুসলমানদের মধ্যে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তন্মধ্যে ভন্ড-নবীদের অপঃতৎপরতা ও যাকাত অস্বীকারকারীদের বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য।
খলীফাতুর রাসুল হযরত সৈয়্যদুনা আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর কঠোর পদক্ষেপ এগুলোর মূলোৎপাটন করতে সফলভাবে সক্ষম হয়েছে। অতঃপর হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর অপরিসীম ব্যক্তিত্ব ও খোদাপ্রদত্ত প্রভাবের সামনে কোন বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিতে সাহস পায়নি। তৃতীয় খলীফা হযরত সৈয়্যদুনা ওসমান গণি যিন্নুরাঈন রাদিয়াল্লাহ তা'আলা আনহুর দীর্ঘ খেলাফত কালে ইসলামের চিরশত্রু ইয়াহুদী-নাসারা ও কাফির চক্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানাবিধ যড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আবদুল্লাহ ইবনে সাবা নামক জনৈক ইয়াহুদী মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও দলাদলি সৃষ্টির লক্ষ্যে নামমাত্র ইসলাম গ্রহণ করে। অতঃপর সে তার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। অল্পদিনের মধ্যে সে বিভিন্ন স্থানে তার যড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক মুসলমানদেরকে তার খপ্পরে ফেলতে সক্ষম হয়। তার অনুসারীগণ প্রথমদিকে ‘সাবায়ী' নামে চিহ্নিত হয়। তারই ষড়যন্ত্রে তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান গণি রাদিয়াল্লাহ তা'আলা আনহু শাহাদাত বরণ করেন। অতঃপর ইসলামের চতুর্থ খলীফা সৈয়্যদুনা মাওলা আলী মুরতাযা রাদিয়াল্লাহ তাআলা আনহুর খিলাফত কালে হযরত ওসমান গণি রাদিয়াল্লাহ তা'আলা আনহুর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সূচনা হয়। একদিকে মুসলমানদের মধ্যে বিশৃংখলা চরম আকার ধারণ করে, অন্যদিকে গোপনে তৃতীয় অপশক্তি আবদুল্লাহ ইবনে সাবার দল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। অবশেষে হযরত আলী ও হযরত আমীরে মোয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমার মধ্যে সমঝোতার চূড়ান্ত পর্যায়ে এ অপশক্তি উভয়ের অজ্ঞাতসারে পরিকল্পিত পন্থায় সমঝোতার পথ রুদ্ধ করে দেয়। তখনও ষড়যন্ত্রকারী শক্তি হযরত আলী রাদিয়াল্লাহ তা'আলা আনহুর অজ্ঞাতসারে তার দলেই আত্মগোপন করে অবস্থান করছিল। অতঃপর হযরত আলী ও হযরত আমীরে মোয়াবীয়া রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমা বিরোধ মীমাংসার পদক্ষেপ হিসেবে দু'জন সাহাবী, হযরত আবু মুসা আশআরী ও হযরত আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমাকে সালিশ মনোনীত করা হলে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহ তা'আলা আনহুর দলে আত্মগোপনকারী ইবনে সাবার অনুসারীগণ আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকে বিচারক মানার অভিযোগে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে কাফির ফতোয়া দিয়ে প্রকাশ্যে তার দল ত্যাগ করে। ইসলামের ইতিহাসে এরা ‘খারেজী' (দল ত্যাগকারী) হিসেবে পরিচিত। এরাই ইসলামে আবির্ভূত প্রথম ভ্রান্তদল। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর প্রতি অতিভক্তি প্রদর্শনকারী একটি দলের সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে এরা 'শিয়া’ নামে পরিচিত। খারেজী ও শিয়া উভয়ের আত্মপ্রকাশ প্রথম দিকে রাজনৈতিক কারণে হলেও পরবর্তীতে এরা কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী জঘন্য।কুফরী আক্বীদা পোষণ করতে আরম্ভ করে । কালক্রমে এ দু’দল আরো অনেক উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে । এমনি করে মুসলমানদের মধ্যে যুগে যুগে অনেক ভ্রান্ত দল-উপদলের আবির্ভাব ঘটে। এ সম্পর্কে পবিত্র হাদিসে ভবিষ্যদ্বাণী বর্ণিত হয়েছে, “আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে, তন্মধ্যে বাহাত্তর দলই জাহান্নামী হবে শুধু একটি দল নাজাত প্রাপ্ত হবে।" ঐ নাজাত প্রাপ্ত দলের নাম হলো- আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বা সুন্নী জামা'আত । এ নাজাত প্রাপ্ত দলটি অলৌকিকভাবে অদ্যাবধি নিজের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। এ যাবৎ আবির্ভূত সকল বাতিল দল-উপদলের মোকাবিলায় হকের ঝাণ্ডা বহন করে আসছে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত'। বাস্তবতার নিরিখে প্রতীয়মান হয়েছে যে, ইসলামের স্বচ্ছ ভূমিতে আফছা স্বরপ তিয়াত্তর নয়, বরং অসংখ্য ভ্রান্ত দল-উপদলের আবির্ভাব ঘটেছে। এ কারণে হাদিস বিশারদগণ আরবী পরিভাষার আলোকে তিয়াত্তর সংখ্যাটিকে সংখ্যাধিক্য অর্থে ব্যবহৃত বলে মন্তব্য করেছেন। অন্যথায় উক্ত সংখ্যা পূর্ণ হয়ে যাবার পর আবির্ভূত ভ্রান্ত দল-উপদলকে ভ্রান্ত বা জাহান্নামী বলা যাবে না, তাদের ধ্যান-ধারণা কুফরী পর্যায় পৌছলেও। সুতরাং হাদিস বিশারদগণের উক্ত মতামত অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও আরবী পরিভাষার আলোকে বিশুদ্ধ। এ যাবৎ আবির্ভূত বাতিল ফিরকা বা দল-উপদলের বিরাট তালিকাও এই মতামতকে সমর্থন করছে। উক্ত বাতিল ও ভ্রান্ত দল-উপদলগুলোর ভ্রান্তির একটি অকাট্য প্রমাণ এই যে,ঐ সব দলের স্থায়িত্ব ও বিস্তৃতি অত্যন্ত সীমিত। অদ্যাবধি সৃষ্ট ভ্রান্ত দলগুলোর অধিকাংশই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায় তাদের পরিচিতি ও ভ্রান্ত আকীদা সমূহের হদিস পাওয়া যায়। বাস্তবক্ষেত্রে অনেক দল-উপদলের অস্তিত্ব থাকবে এবং সর্বশেষ ভ্রান্তদলটি দাজ্জালের সাথে হাত মিলিয়ে সত্যের বিরুদ্ধে লড়বে। এরই আলোকে বর্তমান মুসলিম বিশ্বে যেসব ভ্রান্ত দলের অবস্থান দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে শিয়াকাদিয়ানী, ওহাবী, তাবলীগি ও মওদুদী বা জামাতে ইসলামী।
এ সব ভ্রান্তদলের ভ্রান্তির স্বরূপ সাধারণ মানুষের জানা না থাকায় সরলপ্রাণ মুসলমান বিশেষতঃ আধুনিক শিক্ষিত সমাজ হক-বাতিল পার্থক্য নির্ণয় করতে না পেরে অজ্ঞতাবশতঃ বাতিলের বাহ্যিক আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়ে ভ্রান্তির জালে আটকে পড়ে নিজের ঈমান-আক্বীদা হারাতে চলেছে। এমতাবস্থায় নাজাত প্রাপ্ত দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আত ও বর্তমান বিশ্বে বিদ্যমান ভ্রান্ত দলগুলোর সঠিক ধ্যান-ধারণা ও আক্বীদাসমূহ নির্ভরযোগ্য পন্থায় জনসহমক্ষে তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন ।
এখানে প্রত্যেক ভ্রান্ত দলের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি চিহ্নসমূহ ও ভ্রান্তআক্বীদা, ঐসব দলের ধারক-বাহক আলেমগণের লিখিত কিতাবাদী থেকে উদ্ধৃত করা হলো। আশা করি সত্যান্বেষী পাঠকবৃন্দ অন্ধভক্তির মনোভাব পরিত্যাগ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহ তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে সত্য গ্রহণে সচেষ্ট হবেন এবং হিদায়াতের সঠিক পথ বেছে নেবেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাঁর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত ও সাহাবা কেরাম অনুসৃত পথ ও মত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উপর চলার তৌফিক দান করুন (আমিন)। বেহুরমাতি সাইয়্যেদিল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসহাবিহি আজমাঈন।
( ইসলামের মূলধারা ও বাতিল ফেরকা বই থেকে সংগৃহিত) ।
Comments
Post a Comment