খাজা আজমেরীর জিবনী।
১৮৯৯ সালে জর্জ ন্যাথানিয়েল কার্জন (লর্ড কার্জন) যখন ব্রিটিশ ভারতের ক্ষমতায় বসেন, তার কিছুদিন পরে তিনি একটি যুগান্তকারী মন্তব্য করেন, যে ভারতের ইতিহাসে দুজন ব্যক্তি তাদের মৃত্যূর হাজার বছর পরেও ভারতীয় জনতার হৃদয় শাসন করছে একজন হলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব আরেক জন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী। সম্রাট আওরঙ্গজেব এর ক্ষেত্রে পুরোপুরী সত্য না হলেও খাজায়ে আজমীর এর ক্ষেত্রে এ কথা আজো দিবালোকের মত সত্য। আজো ধর্মবর্ন নির্বিশেষে সবাই ধরনা দেয় আমার খাজার দরবারে।
সে অনেক আগের কথা, ১৪ই রজব ৫৩৬ হিজিরী সনে ইরানের সিস্তান এলাকার সানজার গ্রামে এ পৃথিবীর মাটি হাওয়া আর ফুলকে অভিভুত করে জন্ম নিলেন, খাজায়ে আজমীর। মাত্র ১৫ বছর বয়সে যখন পিতা হারান তখন পুরো পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। পিতার রেখে যাওয়া আঙ্গুর বাগান ছিলো একমাত্র উপার্জনের হাতিয়ার, এরমধ্যে মা ও দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। খাজায়ে আজমীর। মায়ের মৃত্যূ তাকে এতটাই শোকাহত করলো যে তিনি জীবনের প্রতি সব উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন।
কিন্তু যার জন্ম হয়েছে সুলতানুল হিন্দ হয়ে, যার জন্ম হয়েছে এই উপমহাদেশের অন্ধকারে আলো ছড়াতে তিনি কি করে এতো দ্রুত হারিয়ে যান? খাজায়ে আজমীর এর বাগানে আগমন করলেন হযরত ইব্রাহীম কান্দুজী রহঃ। গরীবে নেওয়াজ তাকে এক মুষ্টি আঙ্গুর দিয়ে আপ্যায়ন করলেন, কিন্ত আল্লাহর ওলী হযরত ইব্রাহীম কান্দুজী সেই আঙ্গুর দাঁত দিয়ে চিবিয়ে না খেয়ে সেটি মঈনুদ্দীন এর মুখে ভরে দেন। শুরু হয়ে গেলো মঈনুদ্দীনের খাজায়ে আজমীর হবার পরিক্রমা। অতিশীঘ্রই মঈনুদ্দীন উপলব্ধি করলেন, তিনি আর দশজনের মত ব্যবসা পাতি আর আরাম আয়েশে কাটাতে আসেন নি, তাকে এই দুনিয়ার আরো অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। বেরিয়ে গেলেন সামারকন্দ আর বোখারা অঞ্চলে জ্ঞান আহরন করতে। সেখানে তিনি কোরআন, হাদিস ও ফিকহা শাস্ত্রে পান্ডিত্য লাভ করলেন।
মঈনুদ্দীন জানেন শুধু কোরআন হাদিস জানলেই হয়না এর প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান ও দরকার হয়, যার একমাত্র স্থান হলো আউলিয়ায়ে কেরামের দরবার। তাই সেখান থেকে সোজা চলে গেলেন, বাগদাদে খাজা উসমান হারুনীর কাছে। খাজা উসমান হারুনীর দীক্ষায় সিক্ত হবার পর খাজা উসমান হারুনীর নির্দেশে মঈনুদ্দীন হাজির হয় দরবারে শায়খ মহিউদ্দিন মুহাম্মাদ আব্দুল কাদের জীলানী রহঃ এ। সেই দরবারের ইজাজত নিয়ে আমার খাজা এবার ছুটলেন মদীনার পানে। হজ্ব পালন শেষে মদীনায় গিয়ে যখন আমার রাসুলকে সালাম দিলেন রাসুল রওজা থেকে ডাক দিলেন মঈনুদ্দীন আনতা সুলতানুল হিন্দ, তুমি হিন্দুস্তানের বাদশা। সেই ঘোষনার পর মঈনুদ্দিন রওয়ানা হলেন হিন্দুস্তানের পানে.........
৫৮৬ হিজরী সালে ৫০ বছর বয়সে খাজায়ে আজমীর উপস্থিত হলেন, পাকিস্তানের লাহোরে, সাথে নেই কোন তলোয়ার নেই কোন সৈন্য। হযরত দাতা গঞ্জে বক্স এর দরবারে কাটিয়ে দিলেন ৪০ দিন, এরপর চলে গেলেন মুলতানে সংস্কৃত ভাষা শিখতে। কারন তিনি জানতেন হিন্দুস্তানের মানুষের কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌছাতে সংস্কৃত ভাষার বিকল্প নেই। মুলতান থেকে সরাসরি আসলেন আজমীরে। তখন দিল্লী আর আজমীর ছিলো রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানের অধীনে। রাজা পৃথ্বিরাজ আজমীরের সম্রাটকে তাড়াতে চাইলেন, কিন্তু যে আজমীর আমার মদীনাওয়ালা মঈনুদ্দীনকে লিখে দিয়েছেন তা কি করে তিনি ছেড়ে যান। এর কিছু বছর পরেই শিহাবুদ্দীন গৌরি যিনি আফগান শাসক, দিল্লী আক্রমন করে বসে এবং পৃথ্বিরাজ চৌহানকে হত্যা করে। এরপর থেকে আজমীর আর দিল্লীতে বয়ে যায় ইসলামের ফল্গুধারা। ৬ ই রজব ৬৩৩ হিজরীতে যখন আমার খাজা দুনিয়া থেকে পর্দা করবেন, ততদিনে খাজায়ে আজমীরের হাত ধরে নব মুসলিম হয়েছে ৯০ লক্ষ মানুষ।
খাজায়ে আজমীর সানজেরী রাঃ এর সামনে মালাকুল মউত আজরাইল উপস্থিত। তিনি আজরাইলকে দেখে তাবাসসুম হাসি দিলেন। কারন আজরাইল আসার কিছু আগেই আমার কামলেওয়ালা খাজা বাবার দিদার দিয়েছেন।
রুহ মোবারক দেহ মোবারক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো কিছু আগে, সমস্ত ভক্ত মুরিদানরা চিৎকার করে কাঁদছে। কিন্তু একি খাজা বাবার কপাল মোবারকে এ কি নুরের লিখনি। স্পষ্ট ভাষায় শাহেনশাহে আজমীরের কপালে সবাই দেখতে পেলো একটি নুরানী বাক্য- হাজা হাবিবুল্লা - ইনি আল্লাহর বন্ধু।
খাজা বাবা আজো তাঁর ভক্তদের ঝুলি ভরিয়ে দেন,কি গরীব কি ধনী কেউ খালি হাতে ফিরেনা সেই আলিশান দরবার হতে।
ছবিঃ ১৮৮০ এর শেষের দিকে তোলা আজমীর শরীফের একটি ছবি।
কার্টেছি- ডাঃ শরীফ মহিউদ্দিন।
Comments
Post a Comment