কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষনার দাবী।
রাষ্ট্রীয়ভাবে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করার আহবান!
[ইসলামবিরোধী অমুসলিম কাদিয়ানী সম্প্রদায় তাদের পরিচয় দেয় ‘আহমদিয়া মুসলিম জামাত’ বলে। এমুখোশের আড়ালে তারা তাদের বর্ণচোরা ও প্রতারক চরিত্রতটিকে সক্রিয় রাখে। বাংলাদেশে কাদিয়ানীতৎপরতার ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রিকায় পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে নিজেদের কর্মকান্ডও ‘কৃতিত্বের’ বর্ণনা তুলে ধরেছে। এতে নতুন করে সরলপ্রাণ বহু মুসলিমের প্রতারিত হওয়ার আশংকা তৈরিহচ্ছে। আমরা তাই কাদিয়ানীদের ধর্মবিশ্বাস, মিথ্যাচার ও প্রতারণার প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরতে মাসিকআলকাউসার-এর ২০০৫ সালের মে সংখ্যায় প্রকাশিত এ নিবন্ধটি পুনঃমুদ্রণ করছি।-সম্পাদক]
কাদিয়ানী মতবাদের সাথে ইসলামের বিরোধ কোথায় এবং কেন সচেতন মুসলিম সমাজ কাদিয়ানীদেরঅমুসলিম ঘোষণার দাবি করে-এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে কয়েকটি বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেওয়া প্রয়োজন।
ইসলামের মৌলিক আকীদা
আল্লাহ তাআলা মানব জাতির যোগ্যতা ও উপযোগিতা হিসাবে কালক্রমে তাদের বিভিন্ন শরীয়ত দিয়েছেন।আর এর পূর্ণতা ও পরিসমাপ্তি বিধান করেছেন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে।দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতা লাভের পর যেহেতু এতে কোনোরূপ সংযোজন ও বিয়োজনের প্রয়োজন বা অবকাশ নেই তাইমানবজাতির জন্য নতুন শরীয়তেরও প্রয়োজন নেই। সুতরাং আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূল প্রেরণের ধারাচিরতরের জন্য বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা ইসলামের অন্যতম মৌলিক বিশ্বাস। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনেবলেছেন, (অর্থ) ‘‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করেছি, আর আমি তোমাদের জন্য আমারনেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং দ্বীন হিসেবে ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছি।’’ (সূরামায়েদা : ৩) পবিত্র কুরআনে অন্যত্র বলা হয়েছে, (অর্থ) ‘‘মুহাম্মদ (দ) তোমাদের মধ্যকার কোনো বয়স্ক পুরুষেরপিতা নন, তবে তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী।’’-সূরা আহযাব : ৪০
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অন্যান্য নবীর মুকাবিলায় আমাকে ছয়টি বিষয় দ্বারাবৈশিষ্ট্যমন্ডিত করা হয়েছে, ১. আমাকে অল্প কথায় বেশি ভাবপ্রকাশের যোগ্যতা দেওয়া হয়েছে, ২. আমাকেগাম্ভীর্যজনিত প্রতাপ-প্রতিপত্তি দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে, ৩. আমার জন্য গণীমতের মাল হালাল করে দেওয়াহয়েছে, ৪. সমগ্র ভূপৃষ্ঠকে আমার জন্য নামায পড়ার উপযোগী জায়গা ও পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ হিসেবেস্থির করা হয়েছে, ৫. আমাকে সমগ্র সৃষ্টি জগতের রাসূলরূপে প্রেরণ করা হয়েছে, ৬. আমার দ্বারা নবীদেরসিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে।’’ (সহীহ মুসলিম, মাসাজিদ, হাদীস : ৫২৩)
অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আমার ও নবীদের উদাহরণ এমনএকটি প্রাসাদ, যা খুব সুন্দর করে নির্মাণ করা হয়েছে, তবে তাতে একটি ইটের জায়গা খালি রেখে দেওয়াহয়েছে। দর্শকবৃন্দ সে ঘর ঘুরে ফিরে দেখে, আর ঘরটির সুন্দর নির্মাণ সত্ত্বেও সেই একটি ইটের খালি জায়গাদেখে আশ্চর্য বোধ করে (যে, এতে একটি ইটের জায়গা কেন খালি রইল!) আমি সেই একটি ইটের খালিজায়গা পূর্ণ করেছি। আমার দ্বারা সেই প্রসাদের নির্মাণ পরিসমাপ্ত হয়েছে, আর আমার দ্বারা রাসূলদেরসিলসিলা পরিসমাপ্ত করা হয়েছে।’’ অপর এক রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে, ‘‘আমি হলাম সেই খালি জায়গারপরিপূরক ইটখানি। আর আমি হলাম সর্বশেষ নবী।’’ (সহীহ বুখারী ১/৫০১; সহীহ মুসলিম, ২/২৪৮) অন্য একহাদীসে বলা হয়েছে, ‘‘বনী ইসরাঈলের নবীগণ তাঁদের কর্মকান্ডে নেতৃত্ব ও দিক-নির্দেশনা দান করতেন।যখন তাদের এক নবী দুনিয়া থেকে বিদায় নিতেন, তাঁর জায়গায় আর একজন নবী অধিষ্ঠিত হতেন। কিন্তুআমার পরে কোনো নবী আসবেন না। তবে আমার পরে খলীফা হবে এবং তারা সংখ্যায় অনেক হবে।’’-সহীহমুসলিম, ইমারা, হাদীস : ১৮৪২; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৫৮৭
এরূপ অগণিত কুরআনের আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ইসলামের অন্যতম মৌলিক আকীদা এই যে, হযরতমুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানব জাতির হেদায়াতের জন্য প্রেরিত সর্বশেষ নবী। তাঁর পর আরকোনো নবী প্রেরিত হবেন না।
গোলাম আহমদ কেন নবী নয়?
এ প্রশ্নের সমাধান খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমত উল্লেখ্য যে, ইসলামের উপরিউক্ত মৌলিক ও অকাট্য আকীদারউপস্থিতিতে কেউ যদি নবী হওয়ার দাবি করে তবে সেটা মুসলিম সমাজের নিকট মিথ্যা বলে সাব্যস্ত হবে এবংতা
আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। শুধু তাই নয়, এরূপ দাবি পোষণকারী ব্যক্তি ইসলামের সর্ববাদী বিশ্বাস মুতাবিকমুসলিমই নয়; বরং সন্দেহাতীতভাবে কাফের। সুতরাং গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এরূপ দাবি করার কারণেসম্পূর্ণ মিথ্যাবাদী ও কাফের-এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যাবাদীর জন্ম হবে। তাদের প্রত্যেকে নিজেকে নবী বলে দাবি করবে।অথচ আমি হলাম সর্বশেষ নবী, আমার পরে কোনো নবীর আগমন হবে না।’’-আবু দাউদ, ফিতান, পৃ. ৫৮৪;তিরিমিযী, খন্ড ২, পৃ.৪৫
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী হিসেবে বিশ্বাস করা মুসলমানের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যার এ বিশ্বাসে ত্রুটিরয়েছে, তার ঈমান বহাল থাকার কোনো অবকাশ নেই।
দ্বিতীয়ত ধরে নেওয়া যাক যে, যদি আল্লাহ তাআলা মানব জাতির প্রতি নবী প্রেরণের সিলসিলা বন্ধ না করেঅব্যহত রাখতেন তবু কুরআন, হাদীস ও পূর্ববর্তী নবীগণের জীবনেতিহাস পর্যালোচনা করলে যে শিক্ষা পাওয়াযায় তাতে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বা তার মত স্বভাব-চরিত্রের কোনো লোক নবী হওয়ার জন্য অযোগ্যপ্রমাণিত হয়। এ বিষয়টি সহজে বোধগম্য করার জন্য এখানে চারটি মৌলিক নীতিমালা পেশ করা হচ্ছে। এনীতিগুলো ‘‘দুয়ে দুয়ে চার’’-এর মত সতত সিদ্ধ ও স্বীকৃত সত্য।
প্রথম মৌলিক নীতিটি এই যে, প্রত্যেক সত্যবাদী নবী তাঁর পূর্ববর্তী সকল নবীর প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখেন এবংঅন্যদেরও সকল নবীর সম্মান ও মর্যাদার প্রতি যত্নশীল থাকতে শিক্ষা দেন। কেননা, প্রত্যেক নবী হলেনআল্লাহ তাআলার প্রতিনিধি। তাই কোনো মুসলমান কোনো নবী-রাসূলের প্রতি এরূপ কোনো আচরণ করতেপারে না, যা নবীর জন্য অসম্মানজনক ও অমর্যাদাকর। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, গোলাম আহমদকাদিয়ানী আল্লাহ তাআলার একজন সত্যবাদী মহান নবী হযরই ঈসা আ. সম্পর্কে অত্যন্ত অশোভনীয় কটূক্তিকরেছে। এখানে তার একটি উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে। সে তার ‘দাফেউল বালা’ নামক বইতে বলেছে, ‘‘মাসীহের সততা তার সময়কার অন্যান্য সৎ লোকের চেয়ে বেশি বলে প্রমাণিত হয় না; বরং তার চেয়েইয়াহইয়া নবীর মর্যাদা এক গুণ বেশি। কেননা, সে মদপান করত না এবং কোনো ব্যভিচারিণী নারী নিজেরব্যভিচার থেকে উপার্জিত অর্থ দ্বারা সুগন্ধি ক্রয় করে তার মাথায় মালিশ করেছে এমন কোনো কথা তারব্যাপারে শোনা যায় নি। অথবা এমনও জানা যায়নি যে, এরূপ কোনো নারী নিজের হাত বা মাথার চুল দ্বারাতার শরীর স্পর্শ করেছিল অথবা কোনো আনাত্মীয় যুবতী নারী তার সেবা করত।
এ কারণে আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইয়াহইয়াকে হাসূর (নারী বিরাগী) বলেছেন। কিন্তু মাসীহের এ নামকরণকরা হয়নি। কেননা, উক্তরূপ ঘটনাবলী এরূপ নামকরণের অন্তরায় ছিল।’’
উপরোক্ত উদ্ধৃতিটুকুতে গোলাম আহমদ কায়িদানী হযরত মাসীহ ইবনে মরিয়ম আ.-এর প্রতি কয়েকটিঅপবাদ দিয়েছে। তারমধ্যে একটি হল, তিনি মদ পান করতেন। দ্বিতীয় হল, তিনি ব্যভিচারিণী নারীদেরঅবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ দ্বারা ক্রয়কৃত সুগন্ধি তাদের দ্বারা মাথায় লাগাতেন এবং তাদের হাত ও চুল দ্বারাতার নিজের শরীর স্পর্শ করাতেন। তৃতীয় হল, অনাত্মীয় যুবতী নারীদের সেবা নিতেন।
হযরত ঈসা আ.-এর মত একজন মহান নবীর প্রতি এসব অশ্লীল ও কদর্য অপবাদ আরোপ করার পর সে এরায়ও দিয়েছে যে, এসব ঘটনার কারণেই আল্লাহ তাআলা তাকে পবিত্র কুরআনে ‘হাসূর’ (নারী বিরাগী)বিশেষণ দ্বারা বিশষায়িত করেননি।
যে কোনো নবীর মর্যাদা তো অনেক উর্দ্ধে, একজন সম্ভ্রান্ত ও ভদ্র মানুষের প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করানিশ্চয় তাঁর জন্য অতি অপমানকর। যার মধ্যে অণুপরিমাণও ঈমান আছে, এমন কোনো ব্যক্তি কোনো নবীসম্পর্কে এরূপ অশ্লীল অপবাদ দিতে পারেন না।
কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের লোকেরা বলে থাকে যে, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এসব কথা নাকি খৃস্টানপাদ্রীদের জবাবে তাদের উপর চাপ প্রয়োগার্থে লিখেছে। এটা তাদের নিছক মিথ্যা প্রলাপ ও প্রতারণা।কেননা, ‘দাফেউল বালা’ নামক বইটি মুসলমান আলেমদের উদ্দেশ্যে রচিত। যার ইচ্ছা বইটি যাচাই করেদেখতে পারে। এছাড়াও সে ‘যমীমায়ে আঞ্জামে আথম’ নামক বইতে লিখেছে, ‘‘তার (ঈসা আ.এর) খান্দানওছিল অতি পূত পবিত্র (?)। তার তিনজন দাদী-নানী ছিল ব্যভিচারিণী ও পেশাদার পতিতা। তাদের রক্ত থেকেসে জন্ম লাভ করেছে। হয়ত এটাও খোদা হওয়ার একটি পূর্বশর্ত হবে! পতিতাদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ওদহরম-মহরম সম্ভবত তাঁর উত্তরাধিকারের রক্তের টানেই হয়ে থাকবে। অন্যথা কোনো সৎ পুরুষ একজনযুবতী পতিতাকে এ সুযোগ দিতে পারে না যে, সে নিজের নাপাক হাত তার মাথায় লাগাবে এবং পতিতাবৃত্তিথেকে উপার্জিত অর্থ দ্বারা ক্রয়কৃত অপবিত্র সুগন্ধি তার মাথায় মালিশ করবে, আর নিজের মাথার চুল তারপায়ে ঘষবে। সুধীজন বুঝে নিন, এরূপ লোক কোন চরিত্রের!’’ (যমীমায়ে আঞ্জামে আথম, পৃ. ৭)
উপরে উদ্ধৃত অংশটুকুতেও মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সেই বক্তব্যই পেশ করেছে, যা সে তার ‘দাফেউলবালা’ নামক বইতে বলেছে। ‘যামীমায়ে আঞ্জামে আথম’ বইটি যদিও খ্রিস্টান পাদ্রীদের জবাবে লেখা বটে,তবে তার পূর্বোক্ত বক্তব্যের সাথে এটাকে সংযুক্ত করলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এসব বক্তব্য কেবলইকারও মুখ বন্ধ করার জন্য বলা হয়নি; বরং এটা তার মনের কথা। কেননা, সে ‘দাফেউল বালা’র এক জায়গায়বলেছে, ইবনে মরিয়মের আলোচনা ছাড়, গোলাম আহমদ তার চেয়ে উৎকৃষ্ট।’’ (পৃ. ২)
দ্বিতীয় মৌলিক নীতি এই যে, আল্লাহ তাআলার প্রেরিত কোনো নবী নিজের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যমিথ্যার আশ্রয় নিতে পারেন না। তাঁরা সব সময় সত্যের উপর অটল-অবিচল থাকেন। কিন্তু মির্জা গোলমআহমদ কাদিয়ানী এক্ষেত্রে অবলীলাক্রমে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে। এর অগণিত উদাহরণ রয়েছে। এখানেপ্রবন্ধের কলেবরের প্রতি লক্ষ্য করে একটি মাত্র উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে। মির্জা গোলাম আহমদ তার‘আরবাঈন-৩’ নামক বইতে লিখেছে, ‘‘মৌলবী গোলাম দস্তগীর কাসূরী ও মৌলবী ইসমাঈল আলীগড়ী নিজনিজ বইতে আমার (গোলাম আহমদের) ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেছে যে, আমি যদি মিথ্যাবাদী হই,তবে তাদের আগে মারা যাব। তাদের দাবি মতে আমি যেহেতু মিথ্যাবাদী তাই আমি অবশ্যই আগে মারা যাব।তাদের এ বইগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর অতি দ্রুত তারা মারা গেছে।’’ (আরবাঈন-৩, পৃ. ১১) উপরে উদ্ধৃতঅংশে মরহুম মৌলবী গোলাম দস্তগীর কাসূরী ও মৌলবী ইসামঈল আলীগড়ী সম্পর্কে মির্জা গোলাম আহমকাদিয়ানী যে বক্তব্য পেশ করেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এতে সত্যের বিন্দু-বিসর্গও নেই। তারা এ ধরনের কোনোকথা তাদের বইতে বলেননি। মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর জীবদ্দশায় স্বয়ং তাকে এবং তার প্রয়াণের পরতার অনুসারীদেরকে বহুবার এ চ্যালেঞ্জ পেশ করা হয়েছে যে, যদি উক্ত আলিমদ্বয় এরূপ কোনো কথা তাদেরকোনো বইতে লিখেছেন বলে কোনো প্রমাণ তোমাদের কাছে থেকে থাকে তবে পেশ কর। কিন্ত তারা আজপর্যন্ত কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি এবং কিয়ামত পর্যন্তও দেখাতে পারবে না। (কাযিবাতে মির্জা পৃ. ৭৩)
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর এরূপ মিথ্যাচার প্রচুর। পাঠক জেনে হয়ত আশ্চর্যবোধ করবেন যে, তারবিভিন্ন রচনাবলী থেকে তার মিথ্যাচারগুলো সংকলিত করা হলে বেশ বড়সড় একটি বই হতে পারে। এটা শুধুমুখের কথা নয়; বাস্তবেও যথাযথ উদ্ধৃতিসহ মির্জার মিথ্যাচারের একাধিক সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।তারমধ্যে উর্দূ ভাষায় সংকলিত ‘কাযিবাতে মির্জা’ বইটি বেশ প্রসিদ্ধ। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৭৯; সংকলকমাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াহিদ মাখদূম।
তৃতীয় মৌলিক নীতি এই যে, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে এবংসে দাবি করেছে যে, সে সত্যবাদী নবী। এটা প্রমাণ করার জন্য তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো অক্ষরে অক্ষরেবাস্তবায়িত হবে। আর তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যদি সত্যে পরিণত না হয় তবে সে মিথ্যবাদী বলে সাব্যস্ত হবে।আল্লাহ তাআলার বিশেষ ফজল ও করম যে, তিনি তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে মিথ্যা প্রমাণিত করে তাকেমিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে দিয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, যেখানে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষনবী হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও অসংখ্য হাদীসে এঘোষণার পুনরাবৃত্তি করেছেন আর এ থেকে প্রমাণিত আকীদার উপর মুসলিম সমাজের ঈমান প্রতিষ্ঠিতহয়েছে, সেখানে যে-ই নবী হওয়ার দাবি করুক এবং তার হাতে যত অলৌকিক ঘটনাই প্রকাশ পাক, তাকেকোনো মুসলিম সত্যবাদী নবীরূপে বিশ্বাস করতে পারে না, বরং সে এরূপ যে কোনো অলৌকিক কর্মকান্ডকেদাজ্জালের অলৌকিক কর্মকান্ডের মতই মনে করবে। এ ছাড়া জাদুকরদের কাছেও এ অলৌকিক কর্মকান্ডপরিলক্ষিত হয়, তাতে কেউ তাদের নবী বলে স্বীকার করে না। তেমনি মির্জা গোলাম আহমদেরভবিষ্যদ্বাণীগুলো যদি সত্যও হত তবু সে নবী বলে প্রমাণিত হত না। তবু আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ যে,তিনি তার সত্য-অসত্যের মাপকাঠিরূপে উপস্থাপিত ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে অসত্য প্রমাণিত করে তাঁর দুর্বলঈমানের অধিকারী বান্দাদেরকে এ পরীক্ষা থেকে রক্ষা করেছেন। এখানে আমি কেবল তার দুটি ভবিষ্যদ্বাণীউল্লেখ করব, যেগুলোর মাধ্যমে সে অকাট্যরূপে মিথ্যাবাদী সাবস্ত্য হয়েছে। একটি হল, ডেপুটি আবদুল্লাহআথম নামক জনৈক খ্রিস্টানের মৃত্যু সংক্রান্ত। মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বলেছে যে, ‘‘আথম ৫ জুন১৮৯৩ঈ. থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ঈ. পর্যন্ত অর্থাৎ পনেরো মাস সময়ের মধ্যে মারা যাবে।’’ তারপর পুনরায়১৮৯৩ ঈ. সালের সেপ্টেম্বরে এ ঘোষণা দিয়েছে যে, ‘‘তার বেঁধে দেওয়া সময় সীমা অর্থাৎ ৫ সেপ্টেম্বরেরমধ্যে অবশ্যই মারা যাবে।’’
উল্লেখ্য যে, তখন আথমের বয়স ছিল সত্তরের কাছাকাছি। এসময় তার মারা যাওয়া বিচিত্র কিছু ছিল না। সেভরসা করেই হয়ত মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এরূপ উক্তি করার সাহস পেয়েছিল কিন্তু আল্লাহ তাআলারমর্জি ছিল ভিন্ন রকম, মির্জা গোলাম আহমদকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা, তাই সে বয়ঃবৃদ্ধ আবদুল্লাহ আথমগোলাম আহমদের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে মারা যায়নি; বরং তার পরও প্রায় দু’বছর বেঁচে থেকে ২৭জুলাই ১৮৯৬ঈ. মারা যায়। মির্জা গোলাম আহমদ যেহেতু উক্ত ভবিষ্যদ্বাণীটিকে তার সত্য ও অসত্য হওয়ারমাপকাঠিরূপে পেশ করেছে, তাই তার বেঁধে দেওয়া সময়সীমার পরে আথম যতদিন জীবিত ছিল, তার প্রতিটিমুহূর্ত গোলাম আহমদকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার সাক্ষ্য বহন করেছিল।
আর তার একটি ভবিষ্যদ্বাণী হল মুহাম্মাদী বেগমের বিবাহ সংক্রান্ত। এটি তার সবচেয় প্রসিদ্ধ ও চ্যালেঞ্জপূর্ণভবিষ্যদ্বাণী। এটাকে সে তার বইপত্রে নিজের সত্যতার মাপকাঠি হিসেবে পেশ করেছে। মির্জা গোলামআহমদের এক আত্মীয় ছিল মির্জা আহমদ বেগ। ভারতের হুশিয়ারপুরের অধিবাসী। অনিন্দ্য সুন্দরীমোহাম্মাদী বেগম তারই কন্যা। মির্জা গোলাম আহমদের মনে তাকে বিয়ে করার আগ্রহ জাগে। একদিন সেকন্যার পিতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু আহমদ বেগ সম্মত হননি। মির্জা গোলাম আহমদ মির্জাআহমদ বেগকে প্রভাবিত করার জন্য জোরে শোরে দুটি কথা ঘোষণা করতে থাকে। একটি হল, মুহাম্মাদীবেগম তার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে, এটা সে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী ও ইলহাম দ্বারা জানতে পেরেছে।দ্বিতীয়টি হল, কন্যার পরিবার যদি এতে অমত পোষণ করে তবে তারা নানা রকম বিপদ-আপদে আক্রান্তহবে। মুহাম্মাদী বেগমের উপরও বিপদ আসবে। মির্জা গোলাম আহমদ এসব কথা তার চিঠিপত্রে, বইপুস্তকেও প্রচারপত্রে এত জোরে শোরে লিখতে শুরু করল যে, আহমদ বেগ যদি কোনো কাঁচা মানুষ হতেন তবে ভয়েকন্যা দান করেই বসতেন। কিন্তু তিনি এসবে প্রভাবিত হননি; বরং তিনি নিজের অমতের উপর অবিচলথাকলেন। এভাবে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে যায়, আর মির্জা গোলাম আহমদ মুহাম্মাদী বেগমকে বিয়েকরার জন্য নানা রকম কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। এক পর্যায়ে লাহোরের অধিবাসী সুলতান মুহাম্মাদনামক এক লোকের সাথে মুহাম্মাদী বেগমের বিবাহ ঠিক হয়ে গেলে এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য মির্জাগোলাম আহমদ অনেক আশ্চর্য রকমের চেষ্টা-তদবির শুরু করে। যখন তার সকল চেষ্টা-তদবির ব্যর্থ হয়েযায়, তখন সে তার পূর্বের অভ্যাস অনুযায়ী আল্লাহর ইলহামের বরাত দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে শুরু করে।তাতে সে বলে যে, যদি সুলতান মুহাম্মাদের সাথে মুহাম্মাদী বেগমের বিয়ে হয় তবে বিয়ের পর আড়াই বছরেরমধ্যে মুহাম্মাদী বেগমের পিতা মির্জা আহমদ বেগ মারা যাবে। আর মুহাম্মাদী বেগম বিধবা হয়ে তার বিবাহবন্ধনে আসবে। আল্লাহর লীলা, সুলতান মুহাম্মাদের সাথে মুহাম্মাদী বেগমের বিবাহ হয়ে যাওয়ার পরও মির্জাগোলাম আহমদের পূর্ব ভবিষ্যদ্বাণী আরো জোরে চলতে থাকে। সে বলতে থাকে যে, এটা অদৃষ্টের অলঙ্ঘনীয়লেখা, কেউ এটাকে পরিবর্তন করতে পারবে না। সুলতান মুহাম্মাদ মারা যাওয়ার পর অবশ্যই মুহাম্মাদী বেগমতার স্ত্রী হবে। যদি এটা না হয় তবে সে মিথ্যাবাদী ও নিকৃষ্টতম জীব বলে সাব্যস্ত হবে। (আঞ্জামে আথম ও তারযমীমা) কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার এসব ধোঁকাবাজিকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন এবং তার দম্ভ, অহঙ্কার ও দাবিকেধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। ফলে ১৯০৮ ঈ. সালে যখন মির্জা গোলাম আহমদ মারা যায় তখনও সুলতানমুহাম্মদ ও তার স্ত্রী মুহাম্মাদী বেগম জীবিত থেকে অতি সুখে জীবন যাপন করছিলেন। এমনকি তার প্রয়াণেরপর সুলতান মুহাম্মাদ প্রায় ৪০ বছর জীবিত ছিলেন। যার পরবর্তী জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ও প্রতিটি দিন মির্জাগোলাম আহমদকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার সাক্ষ্য বহন করেছিল। সুলতান মুহাম্মাদ ১৯৪৯ সালে মৃত্যুবরণকরেন।
চতুর্থ মৌলিক নীতিটি হল এই যে, আল্লাহর কোনো নবী তার সমকালীন এমন কোনো ধর্মদ্রোহী শাসকবর্গ বাক্ষমতাধর লোকের চাটুকারিতা, পদলেহন বা তল্পীবহন করতে পারেন না, যাদের প্রত্যক্ষ্য সহযোগিতায় ওপৃষ্ঠপোষকতায় কুফর ও ধর্মহীনতা বিস্তার লাভ করে।
উল্লেখ্য যে, ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী মানুষের মধ্যে ধর্মহীনতা, ধর্মদ্রোহিতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও নৈতিকঅবক্ষয় বিস্তারে যে ভূমিকা রেখেছে, পৃথিবীর মানবেতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমনি একটিদুষ্কর্মের পৃষ্ঠপোষক ইংরেজ সরকারের চাটুকারিতা করতে গিয়ে গোলাম আহমদ কোনোরূপ ত্রুটি করেনি।স্বয়ং গোলাম আহমদ তার ‘শাহাদাতুল কুরআন’ নামক বইয়ের পরিশিষ্টে ‘গভর্নমেণ্টের দৃষ্টি আকর্ষণ’শিরোনামের অধীনে এক জায়গায় বলেছেন, ‘‘এই (ইংরেজ) সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ আমার শরীরেরপ্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রীকে আবিষ্ট করে রেখেছে।’’ তারপর সে লেখে, ‘‘আমি মাননীয় (ইংরেজ) সরকারকে এনিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমি এমনই আজ্ঞাবহ ও হিতাকাঙ্খী রয়েছি, যেমন আমার পূর্বসূরীরা ছিল।… আমিকামনা করি, আল্লাহ তাআলা এ সরকারকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন।’’ (পৃ. ৩)
উপরিউক্ত চারটি মূলনীতি নিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করলেই এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, আল্লাহ তাআলাযদি নবী প্রেরণের সিলসিলা বন্ধ না-ও করতেন তবু গোলাম আহমদের মত চরিত্রের ব্যক্তি নবী হওয়ার জন্যযোগ্য ও উপযুক্ত বলে বিবেচিত হত না। (কায়িদানিয়াত পর গাওর করনেকা সীধা রাস্তা, মাওলানা মুহাম্মাদমনযূর নোমানী রাহ.)
কাদিয়ানীরা অমুসলিম কেন?
কোনো কোনো সাধারণ মানুষ মনে করে যে, কাদিয়ানীদের সাথে মুসলিম সমাজের বিরোধটা হানাফী-শাফেয়ীবা হানাফী-আহলে হাদীস অথবা কেয়ামী-বেকেয়ামীদের মতবিরোধের মত। আসলে বিষয়টি তা নয়, বরংকাদিয়ানীদের সাথে মুসলিম সমাজের বিরোধ এমন একটি মৌলিক আকীদা নিয়ে, যার বিশ্বাস করা-না করারউপর মানুষের ঈমান থাকা-না থাকা নির্ভর করে। এ প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কুরআন পাকেরঅনেক আয়াত ও অগণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত মুসলিম সমাজের অন্যতম মৌলিক আকীদা হল, হযরতমুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী এবং তাঁর পরে কোনো নবীর আগমন হবে না।মুসলমানদের এমন একটি অকাট্য আকীদার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীনিজেকে নবী বলে দাবি করল। সুতরাং সে মুসলমানদের সর্বসম্মত আকীদা মুতাবিক কাফের তথা অমুসলিম।আর যে বা যারা তাকে নবী বলে বিশ্বাস করে সে বা তারা ইসলামের সর্বজন স্বীকৃত আকীদা মুতাবিকমুসলমান থাকতে পারে না। তারা কাফের অর্থাৎ অমুসলিম। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি সহজেবোধগম্য হতে পারে। দেখুন, বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের একটির নাম আওয়ামী লীগ, আরঅপরটির নাম বিএনপি বা বাংলাদেশ জাতায়তাবাদী দল। প্রতিটি দলের ভিন্ন ভিন্ন ম্যানিফেস্টো বা সংবিধানআছে। যে যেই দল করে তাকে সে দলের ম্যানিফেস্টো মেনে চলতে হয়। যদি কেউ দলের সংবিধান লঙ্ঘনকরে বা তার কোনো গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে অস্বীকার করে সে তার দলের সদস্যপদ রক্ষার যোগ্যতা হারিয়েফেলে। তখন তাকে হয় নিজের অপরাধ স্বীকার করে সংবিধানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে দলে থাকতেহয়, নতুবা বহিস্কারের শাস্তি মাথা পেতে নিয়ে দল থেকে বের হয়ে যেতে হয়। ধরুন, কেউ আওয়ামীলীগ করে,কিন্তু সে শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা স্বীকার করে না, এরূপ ব্যক্তি আর যা-ই হোক, আওয়ামীলীগের সদস্য হতে পারে না। কোনো আওয়ামীলীগার তাকে আওয়ামী লীগের সদস্য মেনে নেবে না। এরূপইকেউ যদি বিএনপি করে, কিন্তু জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকার করে না, এমন কাউকেবিএনপি’র লোকজন নিজেদের লোক বলে গ্রহণ করবে না। এ সহজ-সরল মোটা কথাটি যদি বোধগম্য হয়,যে ব্যক্তি ইসলামের অন্যতম মৌলিক আকীদায় বিশ্বাসী নয়; বরং তার বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজেকে‘নবী’ বলে দাবি করে, আর যারা তার এ দাবিকে বিশ্বাস করে তারাও মুসলমান নামের পরিচয় বহন করতেপারে না। তাদেরকেও হয় নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে এবং তওবা করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী মেনে নিয়ে এবং ইসলামের অন্য সকল মৌলিক আকীদাকে মেনে নিয়ে মুসলমানহতে হবে, অথবা মুসলমানের পরিচয় বাদ দিয়ে নিজেদের ভিন্ন ধর্মের নামে পরিচিত হতে হবে। এ কথাটিআমাদের দেশের সাধারণ লোকজন থেকে শুরু করে শাসকগোষ্ঠী পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষ যত তাড়াতাড়ি বুঝেনিতে সক্ষম হবে ততই তাদের দুনিয়ার জীবনে হেদায়াত ও পরকালের শান্তি ও মুক্তির পথ বেছে নিতে সহায়কহবে।
যৌক্তিক বিচারে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি
এদেশীয় মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা যেমন বাংলাদেশের নাগরিক, তেমনিকাদিয়ানী সম্প্রদায়ের লোকেরাও এ দেশের নাগরিক। দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে সকল ধর্মের অনুসারীলোকেরা যতটুকু নাগরিক অধিকার ও সুবিধা ভোগ করে, কাদিয়ানীরাও ততটুকু পাক, এতে কারও দ্বিমতথাকার কথা নয়, তবে সেটা তাদের নিতে হবে নিজের স্বতন্ত্র ধর্মীয় পরিচয়ে-মুসলমান পরিচয়ে নয়। তারানিজেদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে ভিন্ন নামে সমাজে বেঁচে থাকুক, আর্থ-সামাজিক কার্যক্রমে তারা তাদের স^তন্ত্রপরিচয় নিয়ে অংশগ্রহণ করুক, তাতেও কোনো মুসলমানের মাথাব্যাথা নেই। তবে মুসলমানের মৌলিকআকীদায় বিশ্বাসী না হয়ে (উল্টো কুঠারাঘাত করে) তারা মুসলমান পরিচয় ধারণ করবে, এ অধিকার তাদেরনেই। সুতরাং কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি মুসলিম সম্প্রদায়ের আকীদা রক্ষার আন্দোলন তোঅবশ্যই, ধর্মীয় অধিকারের বিষয়ও বটে।
এখন দেখা যাক, কাদিয়ানীরা অমুসলিম রূপে ঘোষিত ও চিহ্নিত না হলে তাতে মুসলমানদের ধর্মীয় ওসামাজিক ক্ষেত্রে কি কি সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ বিষয়টি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, এমন একটি সম্প্রদায়যারা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে অমুসলিম, তারা যদি সরকারীভাবে অমুসলিম ঘোষিত হয়ে পৃথকএকটি ধর্মাবলম্বী দল হিসাবে চিহ্নিত না হয় তাতে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যা সৃষ্টিহয় এবং হতে থাকবে। যেমন :
১. তাদের রচিত ও প্রকাশিত বইপত্রকে মুসলমানদের লেখা বই-পুস্তকের মত মনে করে পাঠ করে সাধারণমানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং ঈমান হারিয়ে বসে।
২. তাদের উপাসনালয়কে মসজিদ মনে করে সেখানে গিয়ে নামায পড়ে। এতে মুসলমানদের কাছে ঈমানেরপরে সর্বোচ্চ যে ইবাদত নামায, তা নষ্ট হয়।
৩. কাদিয়ানী ধর্মমতের অনুসারী কোনো ব্যক্তি মুসলমানের ইমাম সেজে তাদের ঈমান-আমল নষ্ট করতেপারে।
৪. তারা মুসলমান পরিচয়ে নিজেদের মতবাদ-মতাদর্শ প্রচার করলে তাতে সাধারণ মুসলমান তাদেরকেমুসলমানেরই একটি দল মনে করে তাদের মতবাদ গ্রহণ করে নিজেদের সবচেয়ে বড় সম্পদ ঈমান হারিয়েফেলে।
৫. তারা মুসলমান নামে পরিচিত হওয়ার কারণে তাদের সাথে মুসলনামানের মত আচার-আচরণ ও চলাফেরাকরে। অথচ তাদের সাথে মুসলমানের সম্পর্ক হওয়া উচিত এমনই, যেমন কোনো অমুসলিমের সাথে হয়েথাকে।
৬. অনেক সাধারণ মুসলমান তাদেরকে মুসলমান মনে করে নিজেদের বিবাহের উপযুক্তা মেয়েদের তাদেরসঙ্গে বিবাহ দিয়ে অমুসলিমদের হাতে নিজেদের কন্যা তুলে দেয় এবং মুসলিম পাত্রের জন্য কাদিয়ানীধর্মাবলম্বী লোকের মেয়েকে মুসলমান না করে বধু হিসেবে বরণ করে। ফলে এরূপ দম্পতি আজীবনব্যভিচারের গুনাহে লিপ্ত থাকে।
৭. কোনো সম্পদশালী মুসলমান কোনো কাদিয়ানী ধর্মাবলম্বী গরীবকে যাকাত দিলে তার ফরয যাকাত আদায়হবে না।
৮. যে কোনো কাফের তথা অমুসলিমের জন্য হারাম শরীফে ঢোকা নিষেধ। অথচ কাদিয়ানী সম্প্রদায়েরলোকেরা মুসলিম পরিচয় দিয়ে হজ্ব ও চাকরি-বাকরির নামে সৌদি আরবে গিয়ে হারাম শরীফে প্রবেশ করেতার পবিত্রতা নষ্ট করার সুযোগ পায়।
সুতরাং কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে মুসলমান থেকে পৃথক একটি ধর্মের অনুসারী দল ঘোষণা করে ভিন্ন নামেচিহ্নিত না করা হলে এরূপ বহু সমস্যা সৃষ্টি হয়, হতে পারে এবং ভবিষ্যতে হতে থাকবে। এতে মুসলমানসমাজের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কারণে তারা যদি উত্তেজিত হয়ে উঠে তবে এতে দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, যা কারও কাম্য নয়।কাজেই তাদেরকে অবিলম্বে পৃথক একটি ধর্মাবলম্বী দল ঘোষণা করে পৃথক নামে তাদেরকে একটি সংখ্যালঘুদল হিসাবে মর্যাদা দিলে এবং তাদের জন্য ইসলামী পরিভাষাসমূহ যেমন : নামায, রোযা, মসজিদ, হজ্বইত্যাদির ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে তা দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি।এটাই সচেতন মুসলিম সমাজের প্রাণের দাবি।
কাদিয়ানী সম্প্রদায় সম্পর্কে সর্বোচ্চ আদালতের রায়
কাদিয়ানী সম্প্রদায় যেহেতু ইসলামের মৌলিক আকীদার পরিপন্থী আকীদা পোষণ করে, হযরত মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী স্বীকার করে না; বরং তারা মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকেনবী মনে করে এবং তার মতবাদ অনুসরণ করে তাই কোনো আদালত বা পার্লামেন্ট তাদেরকে অমুসলিমঘোষণা করুক, আর নাই করুক, তারা সুস্পষ্ট কাফের অর্থাৎ অমুসলমান। এটা ইসলামের ফয়সালা। তবুইসলামের দুশমন ও ইসলামের জন্য ক্ষতিকর এমন একটি সম্প্রদায়কে মুসলমানের মুখোশ পরে চলার প্রশ্রয়দেওয়া সচেতন মুসলিম সমাজের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই তাদেরকে সরকারীভাবে ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করেপৃথক একটি ধর্মাবলম্বী দল হিসাবে চিহ্নিত করা এবং ইসলামের পরিভাষাসমূহকে তাদের ধর্মীয় কর্মকান্ডেরজন্য ব্যবহার করাকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা আবশ্যক। এটাই সচেতন মুসলিম সমাজের ঈমানী চেতনারদাবি। বহু ত্যাগ ও কুরবানীর বিনিময়ে বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বহু তর্ক-বহসের পর ১৯৭৪ঈ. সালেভুট্টো সরকারের আমলে পাকিস্তান ন্যাশনাল এসেম্বলী কাদিয়ানীদের ‘অমুসলিম সংখ্যালঘু’ ঘোষণা করে এবংতাদের জন্য ইসলামী পরিভাষাসমূহ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তারপর লাহোর হাইকোর্ট ১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৭,১৯৯১, ১৯৯২ ইং সালে, সম্মিলিত শরয়ী আদলত ১৯৮৪, ১৯৯১ঈ. সালে, কোয়েটা হাইকোর্ট ১৯৮৭ঈ.সালে,
সুপ্রিম কোর্ট শরয়ী এপিলেট বেঞ্চ পাকিস্তান ১৯৮৮ঈ. সালে এবং
পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্ট ১৯৯৩ঈ. সালে কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করে। এছাড়া সৌদি আরব,সংযুক্ত আরব আমিরাত, আফগানিস্তান, মুসলিম লীগ, আর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি)কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ওআইসির অন্যতম সদস্য দেশ।
বাংলাদেশ কোর্টের রায়
কাদিয়ানীরা ‘ইসলামেই নবুওয়াত’ নামক একটি বই রচনা করে তাতে কুরআন ও হাদীসের বিকৃত ও মনগড়া অর্থ করে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর নতুন নবীর আগমনের পথ তৈরি করার চেষ্টা করে। বইটি মুসলিম সমাজের আকীদা-বিশ্বাসের মূলে আঘাত হানার কারণে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৫ঈ.সালের আগস্ট মাসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কাদিয়ানীরা সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলাদায়ের করে। হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি জনাব সুলতান আহমদ খান ও বিচারপতি জনাব এম. মাহমুদুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে যথোপযুক্ত শুনানির পর কাদিয়ানীদের আবেদন নামঞ্জুর করেন। মাননীয়বিচারপতিগণ তাদের রায়ে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের পরে নবী আবির্ভূত হওয়ারআকীদাকে কুফরী বিশ্বাস বলে ঘোষণা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন আদালতের রায়ে কাদিয়ানীরা যে অমুসলিমঘোষিত হয়েছে, এ শুনানির মাধ্যমে বাংলাদেশ হাইকোর্ট সে কথাই পুনঃব্যক্ত করেছেন। সংবাদটিবাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ঈ. তারিখে প্রকাশিত হয়।
১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে অন্য একটি মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মাদ আব্দুল জলিল ওবিচারপতি মোহাম্মাদ ফজলুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে আইনের দৃষ্টিতে কাদিয়ানীদের অমুসলিম বলেরায় প্রদান করেন। এর দ্বারা বাংলাদেশে হাইকোর্টের মতেও কাদিয়ানীরা অমুসলিম ঘোষিত হয়েছে। সরকারকর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটিও কাদিয়ানীদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করার সুপারিশ করেছেন।(তথ্য সূত্র : মো : আব্দুল কাসেম ভূঞা, কাদিয়ানী ধর্মমত বনাম ইসলামী দুনিয়ার অবস্থান)
সুতরাং মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালতসমূহের রায় এবং আন্তর্জাতিক সর্বোচ্চ ইসলামী সংস্থা ওআইসি’রসিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ওআইসি’র সদস্যদেশ হিসাবে বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত কাদিয়ানীদেরকেসরকারীভাবে ‘অমুসলিম সংখ্যালঘু’ ঘোষণা করা এবং তাদের জন্য ইসলামী পরিভাষা সমূহের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
Comments
Post a Comment