বিশ্ব ভালবাসা দিবস হালাল না হারাম?
"ভালোবাসা দিবস"
হালাল না হারাম?
- ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী
=======
আজ ছিল ফাল্গুনের প্রথম দিন। ঋতুরাজ বসন্ত শুরু হয়ে গেছে। রাত পোহালেই ১৪ ফেব্রুয়ারি। সাথে বয়ে নিয়ে আসছে বিশ্বব্যাপী 'ভালোবাসা দিবস'। একেক দেশে এবং একেক ভাষায় এর একেক নাম। তবে এর সাথে জড়িয়ে আছে আবেগ এবং উদ্দাম অনুভূতি। ভিন্ন রকম অনুভূতি। যে অনুভূতি একজন যুবক এবং একজন যুবতীকে উত্তাল করে দিতে পারে। আর আমাদের ভৌগলিক সীমারেখায় তো এখন ঋতুরাজ বসন্ত। 'ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত।' বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ায় ভয়াবহ পরিবর্তন দেখা দিলেও, ঋতুরাজ বসন্ত তার আবেদন হারায় নি।
আর যৌবনের ধর্মই হল উত্তাল তরঙ্গের মতো উদ্দাম হয়ে বয়ে চলা। সে বয়ে চলাকে খুব কম মানুষই নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম। এটা স্রষ্টারই দান এবং কৌশল। তিনি চাইলে মানুষকে ফেরেশতাদের মতো রিপুহীন করে তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু মানুষ এবং জিন জাতিকে তিনি মহা পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত করবেন বলেই এদের মাঝে তিনি এমন কিছু দোষ এবং গুণ দিয়েছেন যা নূরের ফেরেশতাদের দেন নি। একদিকে দিয়েছেন ফেরেশতার কিছু গুণাবলী, অন্যদিকে দিয়েছেন শয়তানের ওয়াসওয়াসা, যা রিপু দ্বারা পরিচালিত হয়। ফেরেশতা আর শয়তানের বৈশিষ্টের মাঝে সমন্বয় করতে পারাই হল মহামানুষের চরিত্র। সবাই তা পারে না। আর সবাইকে স্রষ্টা সে ক্ষমতাও দেন নি।
শয়তানি ওয়াসওয়াসার পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য ফাঁদ। মিডিয়া থেকে শুরু করে সমাজ-রাষ্ট্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাকেন্দ্র, রাস্তাঘাট, ঘরে বাইরে - সর্বত্র এর ছাপ লক্ষণীয়। পত্রিকায় বড় বিজ্ঞাপন হবে, থাকবে ক্রোড়পত্র, টিভি চ্যানেলে এ নিয়ে আলোচনা এবং রঙচটা অনুষ্ঠান থাকবে, থাকবে অবৈধ ভালোবাসায় প্ররোচনার হাজারটি উপাদান। এর বিপরীতে লক্ষ্য করা যাবে অল্পকিছু মানুষ এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তারা ধর্মের কথা বলছেন, শালীনতার কথা বলছেন, নীতির কথা বলছেন। অন্যায় ও ন্যায়ের পার্থক্য দেখিয়ে দিচ্ছেন। অবৈধ ভালোবাসার পরিণামের কথা বলছেন। তবে শয়তান সুন্দরের রূপ নিয়ে যা মন্দ এবং গর্হিত তাকেই অনিন্দ্যলালিত্য বলে উপস্থাপন করবে। অসুন্দর এবং পাপকে লোভনীয় করে তুলে সেদিকে মানুষকে ধাবিত করবে।
এ থেকে রক্ষার উপায় কি?
'ভালোবাসা দিবস' হারাম ফতোয়া দেয়া? ১৪ ফেব্রুয়ারি বিজাতীয় সংস্কৃতির অংশ বলে ঢোল পেটানো? যারা এ দিবসকে উৎযাপন করছে তাদেরকে ধর্ম থেকে বের করে দেয়া? না কি অন্য কিছু করা? একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, আমাদের কোন কাজের কি ফল হতে পারে? একবার ভাবুন তো এখন থেকে ১৪শ বছর পূর্বের ঘটনা হলে স্বয়ং দু'জাহানের বাদশাহ (দরূদ) এর কি সমাধান দিতেন? ইমামে আযম হলে কি বলতেন? তার একটি উক্তি সব সময় স্মরণীয় এবং সে অনুযায়ী আমল করা জরুরী। তিনি বলেছেন, 'যুগের চাহিদাকে বুঝতে হবে!' আল্লাহ্ পাক বলেছেন মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে। রাসূল অতুলও (দরূদ) প্রায় একই কথা বলেছেন, হেকমত অবলম্বন করার প্রতি জোর দিয়েছেন। আমরা কি এর কোনোটা গ্রহণ করছি? নাকি গড়পড়তা সব কিছুকে ফতোয়ার কষাঘাতে ভাসিয়ে দিচ্ছি?
মনে রাখতে হবে, পাপ পরিহার্য, ভালোবাসা নয়। কাউকে ভালোবাসা আল্লাহ্র জন্য এবং কারো সাথে শত্রুতাও আল্লাহ্র জন্য। এটাই অসংখ্য হাদিসের মূল বাণী। ভালোবাসার বিপক্ষে না কুরআন, না সুন্নাহ, না যুগের কোনও ইমাম অবস্থান নিয়েছেন। মওলানা রুমি রহঃ ভালোবাসা নিয়ে একটি রুবাইয়্যাত লিখেছেন। একটি নয় অসংখ্য লিখেছেন। এর একটি হলোঃ
খোদা আমার ভালোবাসা, রাসূল (দরূদ) আমার ভালোবাসা
বাবা আমার ভালবোবাসা, মাতা আমার ভালবোবাসা।
ভালোবাসায় জন্ম আমার ভালোবাসায় বেড়ে উঠা
ভালোবাসাই দিতে এলাম, ভালবোবাসায় সকল আশা! [অনুবাদঃ ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী]
সব জায়গায় হারামের ফতোয়া দেয়া ঠিক হবে না। লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। কাজেই ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে পার পাওয়া যাবে না। বরং আমাদের বলা উচিৎ, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভালোবাসা জরুরী। বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, ভাই বোনের প্রতি ভালোবাসা। প্রতিবেশী এবং জীবন চলার পথে আশেপাশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা। ভালোবাসায় দোষ নেই। দোষ হল অন্যায় কিংবা পাপের পথে চলা। ভালোবাসা প্রতিদিনই আছে। একটি দিবসে একে বন্ধী করা উচিৎ নয়। কিন্তু কোনও দিবসকে আবার উপেক্ষা করে সমস্ত মানুষকে অমুসলিম বানিয়ে ফেলাও উচিৎ হবে না। আমরা এ দিবসে আমাদের চারপাশের মানুষকে যেমন ভালবাসবো, তেমনি প্রতিটি দিনে ও প্রতিটি ক্ষণে আল্লাহ্র সৃষ্টিকে ভালোবাসবো। সে ভালোবাসা হবে পাপমুক্ত এবং পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র। যুব সমাজের ধর্মই হলো অন্তরে ভালোবাসার জোয়ার খেলা। সে জোয়ারকে যত বেশি আটকে রাখার চেষ্টা করা হবে, তা তত বেশি বেগে বাঁধ ভাঙা প্লাবনের মতো ছুটে চলবে। বরং তাকে শালীনতা এবং পবিত্রতার আবরণে সীমিত করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মনে রাখতে হবে, ভালোবাসা হারাম নয়, হারাম হল অবৈধ এবং পাপপঙ্কিল পন্থা। আসুন ফতোয়া দেয়া বন্ধ করে কৌশলে অগ্রসর হই। সমস্ত মানুষকে ধর্মের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে আমরা কার কাছে ধর্মের বাণী পৌঁছাবো?
Comments
Post a Comment