সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহঃ এর জিবনী।

#শরীয়ত_ও_ত্বরিকতের_উজ্জ্বল_নক্ষত্র “
জামেয়ার  প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ ছিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি অালায়হি।

সৈয়্যদ মুহাম্মদ অছিয় রহমান।
(পড়ুন ও শেয়ার করুন)।

ভারতীয় উপমহাদেশের এতদঅঞ্চলে যখন মুসলমানদের ঈমান আক্বিদা বিধংসী ইহুদী নসরাদের মদদপুষ্ট মওদুদীবাদ ও ওহাবী মতবাদ এর ক্রম বিস্তার হচ্ছিল, তখনই গাউসুল আযম পীরানে পীর দস্তগীর শায়খ ছৈয়দ মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী আল হাছানী ওয়াল হোসাইনী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রবর্ত্তিত ত্বরিকত জগতের বরহক ছিলছিলা কাদেরিয়া ছিলছিলার অন্যতম দিকপাল, কুতুব-উল-আউলিয়া আওলাদে রাসুল (স.) রাহনূমায়ে শরীয়ত ও তরিক্বত আল্লামা হাফেজ ক্বারী ছৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোটি রহমতুল্লাহে আলাইহ পূণ্যভূমি চট্টগ্রামে পদার্পন করেন।

অবিভক্ত ভারতের সূদুর উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমানে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ) হতে তিনি স্বীয় মুর্শিদ, ত্রিশ পারা সম্বলিত দরুদ শরীফের এক অত্যাশ্চর্য কিতাব প্রণেতা খাজায়ে খাজেগান খাজা আবদুল রহমান চৌহরভী রহমতুল্লাহে আলাইহের নির্দেশে তিনি প্রথমে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল বার্মা মুল্লকে গমন করেন। তিনি ছিলেন বার্মা অন্যতম প্রসিদ্ধ জামে মসজিদ বাঙ্গালী মসজিদের খতিব।

মাত্র বারো বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআনে পাকের হাফেজ হন। অতঃপর কুরআন, হাদীস, ফিক্হ, উসুল ও দর্শন শাস্ত্রে বিশেষ পান্ডিত্য অর্জন করেন। পুঁথিগত বিদ্যায় পান্ডিত্য অর্জন করে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাঁর অসাধারণ শক্তি তাঁকে জ্ঞানের প্রকৃত জগতের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে উদগ্রীব করে তুলল। কাজেই তিনি উপলব্ধি করলেন পান্ডিত্যই খোদা প্রাপ্তির জন্য নিশ্চিত ও নিরাপদ পন্থা নয়।

প্রকৃত জ্ঞানার্জন ও আধ্যাত্মিক সাধনা এখানে পূর্বশর্ত। তাই আল্লামা সিরিকোট (রাঃ) মুর্শিদে কামিলের দরবারে নিয়মিত যাতায়াত এবং আধ্যাত্মিক বিষয়াদির উপর গভীরভাবে রিয়াজাত শুরু করেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে যেমন পান্ডিত্যই যথেষ্ট নয়, বরং কোন চিকিৎসকের সান্নিধ্যে থেকে বাস্তবক্ষেত্রে এর প্রয়োগ বিধির প্রশিক্ষণ নিতে হয়, ঠিক তেমনি আল্লাহর পরিচয়ের ব্যাপারেও এ কথাটি সমভাবে প্রযোজ্য। এ উপমাকেই তিনি বাস্তবক্ষেত্রে বেছে নিলেন। আল্লামা শাহ সুফী সিরিকোট (রাঃ) অলীকুল শিরোমণি কুতুবুল আকতাব হযরতুল আল্লামা শাহ সুফী আবদুর রহমান চৌহরভী (রাঃ) এর হাতে বায়’আত (শিষ্যত্ব) গ্রহণ করেন।

♣♣ রেয়াযত ও মুজাহাদা :-

এরপর শুরু হলো তাঁর সাধনার অন্তহীন প্রচেষ্ঠা। বছরের পর বছর তিনি কঠোর থেকে কঠোরতর এবাদত ও সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। আপন মুর্শিদের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ আত্মোৎসর্গকারী একজন মুরীদ। একটি ঘটনা থেকে তাঁর মুর্শিদ প্রেমের গভীরতা বুঝা যাবে। পীর ছাহেব ক্বিবলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দীর্ঘদিন যাবত সিরিকোট শরীফ হতে অতি দুর্গম গিরিপথ অতিক্রম করে প্রত্যহ অরণ্য হতে নিজ হাতে জ্বালানী কাঠ কেটে নিজের মাথায় বহন করে প্রায় #আঠার মাইল দুরে অবস্থিত তাঁর পীর সাহেবের আস্তানা পাক ছৌহর শরীফে নিয়ে আসতেন (সোবহানাল্লাহ)।

যমানার একজন প্রখ্যাত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আলেম, হাফেজ ক্বারী হওয়া সত্বেও নিজের মান সম্মান সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আল্লাহ ও রাসুল পাক (দঃ) কে পাওয়ার জন্য পীর প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বিশ্ব ঈমানদার মুসলিমদের সামনে।

এ ছাড়াও তিনি আপন মুর্শিদ ক্বিবলার ইঙ্গিত ছাড়া কিছুই করতেন না। এক কথায় ফানা ফিশ্শায়খের এক উচ্চতম আসনে সমাসীন ছিলেন তিনি। অনেকদিন পীর ছাহেব ক্বিবলার সান্নিধ্যে থেকে যখন তিনি জাহেরী বাতেনী উভয় দিক দিয়ে পরিপূর্ণ হলেন তখন তাঁর পীর ছাহেব ক্বিবলা তাঁকে নিজের খলীফা বানিয়ে দেশ বিদেশে হিদায়তের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। পীর ছাহেব ক্বিবলার আদেশক্রমে দ্বীন ইসলাম-এর খেদমতের লক্ষ্যে তিনি সুদুর রেঙ্গুন এ দীর্ঘদিন যাবত কঠোর পরিশ্রম ও সাধনায় দিনাতিপাত করে পীর ছাহেবের আদেশের মর্যাদা রক্ষা করেন।

রেঙ্গুণে অসংখ্য নরনারী আলেম হাফেজ সাংবাদিক ও অফিসারবৃন্দ কাদেরিয়া তরীক্বায় তাঁর হতে মুরীদ হয়ে আল্লাহ ও রাসুল পাক (দঃ) এর পরিচয় লাভে ধন্য হন। তাঁদের মধ্যে দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, সুফী আবদুল গফুর, ডাঃ টি হোসেন ও মাষ্টার আব্দুল জলিলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ মহান ব্যক্তিদের উসিলায় এ দেশের আপামর মুসলিম জনতা একজন আল্লাহর প্রকৃত অলীর সান্নিধ্যে আসার ও তরীক্বতের সবক নেয়ার সৌভাগ্য নসীব হয়েছে।

এজন্য আমরা এ মহান ব্যক্তিদের নিকট সবচেয়ে বেশী ঋনী ও কৃতজ্ঞ। আল্লাহ পাক তাদের দরজাত বুলন্দ করুন! আমীন!

অতঃপর হুযুর ক্বিবলা বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে তরীক্বতের ধারায় সিক্ত করার জন্য এদেশে তাশরীফ আনেন। এরপর ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আন্দরকিল্লাস্থ তাঁর কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসে এ মহান অলীর অবস্থানের ব্যবস্থা করার সৌভাগ্য লাভ করেন। সেই সময় উক্ত প্রেসই ছিল সকল পীর ভাইদের যোগাযোগের স্থান।

এখানে বিশেষতঃ চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ হুযুর ক্বিবলা (রাঃ) এর সান্নিধ্যে এসে তরীক্বায়ে কাদেরিয়ার অমৃত সুধা পান করে ধন্য হতে লাগলেন। অতঃপর প্রখ্যাত সমাজসেবী ও ধার্মিক ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আল-কাদেরীর একান্ত আগ্রহে তাঁর নিজস্ব ভবনে বলুয়ার দীঘির পাড়স্থখানেকায় কাদেরিয়া সৈয়দিয়া তৈয়বিয়া প্রতিষ্ঠিত হলে সেই খানকায় অবস্থানকরে তিনি শরীয়ত ও তরীক্বতের অমীয় বাণী পৌছাতে শুরু করলেন।

এ মহান অলী আল্লাহর ও রাসুল (দঃ) এর নৈকট্য হাসিল করার একমাত্র পন্থা হলো সুন্নতে নববীর পরিপূর্ণ এত্তেবা।
তাঁর নিস্কলুষ চরিত্রের অন্যতম সৌন্দর্য্যই ছিল প্রতিটি কাজে সুন্নতের পূর্ণ মর্যাদা প্রদান। একটি সুন্নাতও তিনি সাধ্য থাকতে ছাড়তেন না।

চারিত্রিক দিক দিয়েও ছিলেন সকল প্রকার আপত্তির উর্ধে। এক কথায় তাঁর চরিত্রে ফুটে উঠত প্রিয় নবী (দঃ) এর আদর্শের প্রতিচ্ছবি। একদিকে দেখা যায় তিনি পরম শত্রুকে ক্ষমা করেছেন। অপরদিকে তিনি বীর সেনানীর মত ফেরকায়ে বাতেলা ওঅন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে নির্ভীকভাবে সংগ্রাম করেছেন।

একদিকে দেখা যায় তাঁর হাতে অজস্র ধন দৌলত আসছে- অপরদিকে তা সৃষ্টির কল্যাণের জন্য অকাতরে দান করে দিচ্ছেন। পার্থিব কোন প্রকার কলুষতা তাঁর মধ্যে স্থান পায়নি। বস্তুতঃ নৌকা যেমন পানির উপর দিয়ে চলে, পানি কিন্তু নৌকার মধ্যে ঢুকেনা, ঠিক এ মহান অলীর ব্যাপারেও এক কথাটি সমানভাবে প্রযোজ্য।

সংগঠন :-

একথা অনস্বীকার্য সত্য যে, বৃহৎ কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারী প্রত্যক্ষ উদ্যোগের কথা বাদ দিলে মজবুত সংগঠনের কথাই সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এ গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য করে হুযুর ক্বিবলা আল্লামা সিরিকোটি (রাঃ) ১৯২৫ সনে বার্মার রেঙ্গুণে আঞ্জুমানে শুরায়ে রহমানিয়া নামক একটা দ্বীনিসংস্থা কায়েম করেন। যে সংস্থা প্রথমে রেঙ্গনে বহুবিধ তরীক্বত ও দ্বীনি ভূমিকা পালন করে।

আধ্যাত্মিক এলমের অধিকারী হযরত আব্দুর রহমান চৌহরভী (রাঃ)- এর লিখিত ত্রিশ পারা (১৪৪০ পৃ) সম্বলিত বিশ্ববিখ্যাত দুরুদ শরীফের কিতাব মজমু’আয়ে সালাওয়াতির রাসুল (দঃ)- এর ১ম প্রকাশনার কাজ সমাধান করেন। তদুপরি, হযরত চৌহরভী (রাঃ) এর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা-এ-ইসলামিয়া রহমানিয়া ও হযরত সিরিকোটি  (রাঃ) সুচারুরূপে পরিচালনা করেন।

আল্লামা সিরিকোটি (রাঃ) বাংলাদেশে তশরীফ আনার পর এ সংস্থা মজলিশে শুরা-এ-রহমানিয়া, আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহামদিয়া সুন্নিয়া রূপ লাভ করে যা সরল প্রাণ মুসলমানদেরকে বাতেল ফেরকার খপ্পর থেকে সত্যের মহিমায় নিজ আত্মা ও ঈমানের সম্পর্ক সুদৃঢ় করার সুযোগ এনে দিয়েছে। এ-দ্বীনি সংগঠন আঞ্জুমান শুধু এদেশে নয়, বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও একটা খাঁটি সুন্নী প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।

এটা এদেশের সুন্নী মুসলমানদের গৌরবের বিষয় নয় কি? তিনি আঞ্জুমানের পরিচালনায় সর্বপ্রথম ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এ মাদ্রাসা সমগ্র বাংলাদেশে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারীদের সেতু বন্ধন রচনা করছে। এ জামেয়া সম্পর্কে হুযুর ক্বিবলা (রাঃ) এরশাদ করেছেন এই জামেয়া হচ্ছে নুহ (আঃ) এর কিস্তী স্বরূপ।

এক কথায় বলতে হয় জামেয়া মুর্শিদে বরহকের ফুয়ুজাতের নাহার। যে কোন বালা মুসীবত, রোগ মুক্তি ও সর্বপ্রকার বৈধ বা সৎ উদেশ্য হাসিলের নিয়তে জামেয়া এবং আঞ্জুমান পরিচালিত অপরাপর মাদ্রসাসমূহের নামে সাধ্যমত মান্নত করলে আল্লাহর রহমতে হুযুর ক্বিবলার উসিলায় তাঁর নেক মকসুদ পূর্ণ হয়। দুনিয়ায় এরূপ নগদ সওদা বিরল।

পক্ষান্তরে মুর্শিদে বরহকের নজর ক্রমে অলৌকিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আঞ্জুমান পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক লক্ষ লক্ষ টাকার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে। এটা হুযুর ক্বিবলার কামালিয়াতের বর্হিঃপ্রকাশ।

আল্লাহর অলীদের কারামত সত্য এবং  এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বিখ্যাত আকায়াদ নাসাফিতে আছে, কারামতুল আউলিয়ায়ে হাক্কুন, অর্থাৎ আল্লাহর অলীদের কারমত সত্য, তাঁদের কথাবার্তা কারামত, কার্যকলাপ চাল-চলন, আপদমস্তক কারামত। তাঁদের সানিধ্যে এমনকি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে আসলেও আল্লাহ এবং রাসুল (দঃ) এর প্রেম ও সান্নিধ্য নিয়েই ফিরে যায়। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর বন্ধু নবী রাসুল (দঃ) ও অলীদের এই ইখতিয়ার দান করেন বন্ধুত্বের কারণে। আল্লামা ছিরিকোটি (রহঃ) এর জীবনে অনেক কারামত বিদ্যমান, তা সংক্ষিপ্ত পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না, এর পরও পাঠক সমাজ জানার জন্য সামান্য তুলে ধরলাম।

কারামতের কয়েকটি উদাহরণ ঃ

ছুরতী সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ‘ছুরতীওয়ালা’ বিদ্বেষ প্রসূত হয়ে একদা হুযুর ক্বিবলাকে মুরীদানসহ খানার দাওয়াত দিল। যথাসময়ে হুযুর সঙ্গী মুরীদান নিয়ে খানার দাওয়াতে হাজির হলেন। মেজবান তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন এবং ভাঁজ করা একটি পাঞ্জাবী হুযুরকে তোহফা হিসেবে নজরানা দিলেন।

হুযুর এটা সবার সামনে খুলে দেখলেন যে পাঞ্জাবীটার বাম হাত লম্বা, ডানহাত অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট। সামনের দিকে হাঁটু পর্যন্ত ঝুলানো, পিছন দিকে দিয়ে কোমর পর্যন্ত উঠানো। এ কাজ-কারবার দেখে সঙ্গী মুরিদরা মনে মনে ক্ষীপ্ত হযে উঠলেন। একি ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ! না, হুযুর ক্বিবলা এটা দেখে খুবই আনন্দিত হয়ে বললেন, ‘বেটা ইয়ে বহুত আচ্ছা ডিজাইন হুয়া, ডান হাত দেখে লিখনেকা আওর পিছে ছে টয়লেট আবদাছ করনেকে লিয়ে আচ্ছা হোগা। ইনকে লিয়ে দো’আ করো। সকলে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এত বড় একটা বেয়াদবী করার পরও হুযুর তাঁর জন্য দো’আ করলেন!

আল্লাহ তা’আলা যেমন দয়ার সাগর তাঁর মাহবুব গণও তেমনি উদার ও দয়াদ্রচিত্ত। খানা দেয়া হল, ছুরতীওয়ালার ছেলে হাত ধোঁয়ানোর জন্য লোটা-পাত্র নিয়ে হাজির হল। হুযুরের হাত ধোঁয়ানোর জন্য যেমাত্র ছেলেটি নীচ হল সে লক্ষ্য করল যে তার পকেটের মানি ব্যাগ নেই। মনে মনে সে চিন্তিত হয়ে পড়ল, এদিকে হুযুর ক্বিবলা হাত সাফ করার সময় ফিসফিসিয়ে তাকে বললেন, ‘মিল যায়েগা’। বিভিন্ন প্রকারের খাদ দ্রব্য তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু সবকিছুতেই অত্যদিক ঝাল লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

হুযুর ক্বিবলা ঝাল খান না বললেই চলে। ছুরতীরাও ঝাল খুব কম খায়। কিন্তু শত্রুতাবশতঃ সেদিনের তরকারিতে অধিক ঝাল দেয়া হয়েছিল। তার ইচ্ছে ছিল হুযুর ক্বিবলাকে একটু পরীক্ষা করা। হাত সাফ হয়ে গেলে ছুরতী হুযুর ক্বিবলাকে খানা শুরু করার জন্য অনুরোধ জানালো। হুযুর খানা শুরু না করে বললেন, বেটা এক মেহমান আনেওয়ালা হ্যায়, উন্কা উনতেজার মে হ্যায়।

ও কথা বলার কিছুক্ষণ পরেই এক ব্যক্তি দুই হাতে দু’পাত্র দধি নিয়ে হুযুরের খেদমতে হাযির হলেন। সঙ্গীদের লক্ষ্য করে হুযুর বললেন, তরকারির সাথে দধিটুকু মিশিয়ে দাও। দধি মেশানোর ফলে একটু আগের ঝাল তরকারি অতি সুস্বাধু খাদ্যে পরিণত হল। এদিকে ছুরতীর ছেলে তার হারানো মানি ব্যাগটাও পেয়ে গেল। খাওয়া শেষ হলে ছুরতী তনয় পুনরায় হাত সাফ করাতে এলে হুযুর ক্বিবলা জিজ্ঞেস করলেন, ‘মিল গিয়া।’ সে বলল, জ্বি ‘মিল গিয়া।’ এ সকল কারামত প্রত্যক্ষ করে ছুরতী পরিবারের সকলে লজ্জাবনত হয়ে হুযুরের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করল এবং সিলসিলায় দাখেল হয়ে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে শত্রু আপন হয়ে গেল।”

জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা স্থাপন ও সিরিকোটি (রঃ) এর অপূর্ব কারামত। ১৯৫৪ সালের প্রথম দিকে ষোলশহরস্থ নাজিরপাড়া এলাকায় এ মাদ্রাসার ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করা হয়। মাদ্রাসার জন্য অনেক যায়গার খবর দেয়া হলেও হুযুর ক্বিবলার পছন্দ হয়না। হযুর বললেন, এ্যাসা এক যায়গা তালাশ করো, জো শহর ভি নেহী আওর গাঁওভি নেহী। মসজিদ ভি রেহনা চা’হিয়ে আওর সাথ তালাব ভি চা’হিয়ে। অর্থাৎ এমন একটি যায়গার খোঁজ কর যা শহর এলাকাও নয় আবার গ্রামও নয়।

মসজিদও থাকা চাই আবার সে সাথে পুকুর ও হওয়া চাই। বর্তমান মাদ্রাসাস্থান যা হুবহু হুযুরের মন্সা মোতাবেক পাওয়া যায় তার প্রথম সন্ধান দেন নাজির পাড়া নিবাসী মরহুম নুরুল ইসলাম সওদাগর ছাহেব। স্থানীয় বৈরী পরিবেশ ও প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করে মাদ্রাসা কায়েমে তাঁর অবদান ছিল অসীম। মাদ্রাসার জন্যে আলহাজ্ব হযরতউদ্দিন চৌধুরী প্রকাশ হযরত মিয়া চৌধুরী (মরহুম মাগফুর) অতি আন্তরিকতার সাথে এক খন্ড জমি ও পুকুরের কিছু অংশ প্রদান করেন।

এ মাদ্রাসাকে হুযুর ক্বিবলা হযরত নুহ (আঃ) এর নৌকার সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলতেন, ‘দ্বীন কো বাঁচাও ইসলামকো বাঁচাও সাচ্চা আলেম তৈয়ার করো। মুঝে দেখনা হ্যায়তো মাদরাসা কো দেখো, মুঝছে মুাহব্বত হ্যায় তো মাদ্রাসাকো মুহাব্বত করো। এ মাদরাসাটিহুযুর ক্বিবলার জিন্দা কারামাত। তিনি স্পষ্ট করে বলে গেছেন, নেক মকসুদ হাসিলের জন্য কোন ব্যক্তি এ মাদ্রাসার জন্য মান্নত করলে তার সুফল পাওয়া যাবে ইনশা আল্লাহ।

আশা পুর্ণ না হলে দান করবেন না। মকসুদ পূর্ণ হওয়া মাত্র মান্নত পূর্ণ করে দেবেন । সে থেকে অদ্যাবধি হাজার হাজার ভক্ত অনুরক্ত এভাবেই এ মাদরাসার জন্য দান করে আসছে। সে সাথে দুনিয়া ও আখিরাতের কামিয়াবী হাসিল করছে। এ দেশে অনেক মাদ্রাসা বর্তমান থাকা সত্বেও এ মাদরাসার অবদান কালজয়ী।

হাজার হাজার ছাত্র কুরআনে হাফেজ, হাদীস, ফিক্হ প্রভূতি বিষয়ে গভীর জ্ঞান লাভ করে দেশে, বিদেশে সুখ্যাতির সাথে দ্বীন ও মযহাবের খেদমত করে আসছে। সুন্নীয়া মাদ্রাসা নামেও এটা সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে। এ ছাড়াও মাদ্রাসা-এ- তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া, হালিশহর, জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া মুহাম্মদপুর ঢাকা, প্রভৃতি মাদ্রাসা আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া ছুন্নিয়ার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। এ ছাড়াও শতাধিক আক্বীদা ভিত্তিক মাদ্রাসাকে আনজুমানের পক্ষ হতে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করা হয়।
এসব দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আনজুমানের যাবতীয় কার্যক্রম হুযুর ক্বিবলার রুহানী ফয়েজের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে।

মুর্শিদে বরহকের নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে সারা দেশে প্রতিটি জেলা উপজেলায় এবং মহল্লায় পীর ভাই ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের যৌথ উদ্যোগে মাদ্রাসা মক্তব স্থাপন অব্যাহত রয়েছে। পীর ভাইগণ নিজ নিজ এলাকায় অতি মুহাব্বতের সাথে খতমে গাউসিয়া, গেয়ারবী ও বারবী শরীফ, মুর্শিদে বরহক প্রদত্ত জিকির আজকার এবং মিলাদ মাহফিল চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিশেষতঃ হুযুর ক্বিবলার প্রতিষ্ঠিত বলুয়াদীঘির পাড় এবং নব প্রতিষ্ঠিত ষোলশহর খানকা, খানকা এ কাদেরিয়া সৈয়দিয়া তৈয়বিয়াতে অতি জাঁকজমকের সাথে প্রতিদিন বাদে ফজর খতমে গাউসিয়া শরীফ এবং গেয়ারবী শরীফ আদায় করা হয়। এতে বিশ্ব মুসলিমের সার্বিক উন্নতি কামনা করে মুনাজাত করা হয়। সুন্নিয়াত তথা ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান লাভ করার প্রয়াস পায়।

এ দেশে হুযুর ক্বিবলার শুভাগমন এবং তাঁর প্রতিষ্টিত যাবতীয় দ্বীন মযহাবী প্রতিষ্ঠান সমুহের কার্যক্রম আমাদের তথা সুন্নী মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তা’আলা ও নবী করীম (দঃ) এর পক্ষ থেকে এক মহান নেয়ামত ও আশীর্ব্বাদস্বরূপ। নবীর (দঃ) শুভাগমন না হলে আমরা যেমন কাফের ও বেদ্বীন হয়ে যেতাম ঠিক তদ্রুপ হুযুর ক্বিবলা এদেশে শুভাগমন না করলে বাতিলদের প্ররোচনায় আমাদের ঈমান হারা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল অত্যাধিক।

সাড়ে তিন হাজার মাইল দুর থেকে এসে তাঁরা এখানে ব্যবসা বাণিজ্য করেননি বরঞ্চ আল্লাহ রসুল (দঃ) এর পথে থাকার পাথেয় সরবরাহ করে গেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সাথে। তাঁদের এ অবদান ভুলবার নয়। তিনি শুধু এ দেশে নয় সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে দ্বীন ও মিল্লাত এবং মাজাহাবের প্রচার ও প্রসার করেছেন।

ড. ইব্রাহীম মাহদী রচিত A short history of Muslims in South Africa নামক একটি প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯১১ সালে আফ্রিকার মোম্বাসা বন্দুর ভারতীয় ব্যবসায়ী ছৈয়দ আহমদ শাহ পেশওয়ারীর অক্লান্ত পরিশ্রমে মুসলমানদের প্রথম প্রার্থনা গৃহ বা জামে মসজিদ তৈরি হয়।

পরবর্তীকালে তিনি এখানে মুসলমানদের হানাফী মজহাবে দীক্ষিত করার প্রয়াস নেন। এসময় পারস্য এলাকা থেকে আগত কিছু মুসলমান দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলমানদের মধ্যে শিয়া মতবাদ প্রচারেও ব্যাপৃত ছিলেন। তবে ভারতীয় মুসলমান ব্যবসায়ীদের মধ্যে সে সময় যারা দক্ষিণ আফ্রিকায় ইসলামের প্রচার-প্রসারে নিয়োজিত ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের কাছে তাদের প্রভাবই ছিল বেশি।

ড. মাহদী প্রণীত এই ঐতিহাসিক গ্রন্থে বর্ণিত, এ ভারতীয় ব্যবসায়ী ছৈয়দ আহমদ শাহ পেশওয়ারী যে বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জিলার ছিরিকোট শরীফের কুতুবুল আউলিয়া হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ ছিরিকোট (রহ.) সেই ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। প্রসঙ্গত, তিনি আঠার’শ শতকের শেষ প্রান্তে ব্যবসায়ী হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা গমন করেছিলেন এবং সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করেছিলেন।

নবী করিম (দ.) এর ৩৯তম বংশধর হাফেজ ক্বারী ছৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোট (রহ.), ১৩৮০ হিজরীর ১১ জ্বিলকদ ছিরিকোট শরীফে ওফাতপ্রাপ্ত হন। প্রতিবছর এদিন চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ বাংলাদেশের সর্বত্র, পাকিস্তান, ভারত, বার্মা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, লন্ডনসহ পৃথিবীর বিভিন্নস্থানে হুজুর ক্বিবলার ওরশ মোবরক যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় অনুষ্ঠিত হয়।

বিশেষ করে চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া ময়দানে আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাষ্ট্রের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ওরশ মাহফিলে লক্ষ লক্ষ ভক্ত-অনুরক্ত শরীক হন এবং অশেষ পুণ্য হাসিল করেন। মহান রাব্বুল আলামিনের আলিশান দরবারে ফরিয়াদ তিনি যেন আমাদেরকে হুজুরকেবলার আদর্শ বাস্তব জীবনে প্রতিপলন করার তৌফিক এনায়েত করেন। আমিন, সুম্মা আমিন।

Comments

Popular posts from this blog

ছবছে আওলা ও আ'লা হামারা নবী।

খাজা গরীবে নেওয়াজ এর জিবনী।

পিডিএফ বই ২৮ টি একত্রে।