ঈদে মিরাজুন্নাবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।

প্রসঙ্গঃ মিরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। লেখকঃমুফতি মাওলানা মুহাম্মদ বখতিয়ার উদ্দিন।

হযরত ক্বাতাদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি হযরত আনাস ইবনে মালিক হতে, তিনি মালিক ইবনে সাআ হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে মি’রাজ রজনীর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে যে, আমি হাতিমে কা’বার অংশে শুয়েছিলাম হঠাৎ দেখলাম এক আগন্তুক এসে আমার বক্ষকে এখান থেকে এই পর্যন্ত অর্থাৎ কন্ঠনালী থেকে নাভী পর্যন্ত বিদীর্ণ করলো। অতঃপর আমার ক্বলব বের করল আর আমার কাছে স্বর্ণের একখানা থালা আনা হলো, ্যা ঈমান ও বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ ছিল। তাতে আমার কলব ধৌত করা হলে আমার কলব ঈমান ও বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। পরিশেষে তা যথাস্থানে রেখে দেয়া হয়। এরপর আমার সামনে আরোহনের একটি জন্তু হাযির করা হয়, যা আকারে খচ্চরের চেয়ে ছোট আর গাধার চেয়ে বড়। তার দৃষ্টি যতদূর যেত সেখানে সে পা রাখত। আমি তার উপর আরোহন করলাম। অতঃপর জিব্রাঈল (আগন্তুক) আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঊধর্্বলোকে যাত্রা করলেন। এমনকি আমরা প্রথম আসমানে পৌছে গেলাম। জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম প্রথম আসমানের দরজা খুলতে বললে ভিতর থেকে আওয়াজ এলো, কে? উত্তরে বললেন, আমি জিব্রাঈল। আসমানের ফেরেশতারা আবার জিজ্ঞেস করলে, আপনার সাথে কে? বললেন ‘মুহাম্মদ’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। আবার জিজ্ঞেস করা
হল, তাঁকে কি দাওয়াত করা হয়েছে? উত্তর দিলেন-হ্যাঁ। বলা হল, তাঁকে সাদর সম্ভাষণ, কতই উত্তম তাঁর শুভাগমন। দরজা খুলে দেয়া হল। অতঃপর এখানে দেখা হয়ে গেল হযরত

আদম আলাইহিস সালাম এর সাথে। জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম বললেন, তিনি আপনার পিতা
সালাম প্রদান করুন। আমি সালাম দিলাম। আর তিনি জবাব দিয়ে বললেন, পুণ্যবান পুত্র ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। অতঃপর জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আমাকে উপরের দিকে দ্বিতীয় আসমান পর্যন্ত নিয়ে গেলেন আর দরজা খুলতে বললেন। ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করা হল-কে? তিনি বললেন আমি জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। আবার জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে দাওয়াত করা হয়েছে? জিব্্রাঈল আলাইহিস সালাম বললেন- হ্যাঁ। এবার আওয়াজ এল, তাঁর প্রতি সাদর সম্ভাষণ; কতইনা উত্তম ও বরকতময়। এ বলে দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর আমি দ্বিতীয় আসমানে প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ও হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামকে। তারা দু’জন পরস্পর খালাত ভাই। জিব্রাইল আলাইহিস সালাম বললেন, এরা ইয়াহইয়া ও ঈসা, আপনি তাদের প্রতি সালাম প্রদান করুন। আমি তাদের প্রতি সালাম প্রদান
করলাম। তাঁরা উভয়ে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, পুণ্যবান ভাই ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ।
অতঃপর জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আমাকে উপরের দিকে তৃতীয় আসমানে নিয়ে গেলেন আর দরজা খুলতে বললেন। ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করা হল-কে? তিনি বললেন আমি জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। আবার জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে দাওয়াত করা হয়েছে? জিব্্রাঈল আলাইহিস সালাম বললেন- হ্যাঁ। এবার আওয়াজ এল, তাঁর প্রতি সাদর সম্ভাষণ! কতইনা উত্তম ও বরকতময়। এ বলে দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর আমি তৃতীয় আসমানে প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম-কে। জিব্রাইল আলাইহিস সালাম বললেন, ইনি ইউসূফ আলাইহিস সালাম বললেন তাকে সালাম প্রদান করুন। আমি তাঁকে সালাম প্রদান করলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, পুণ্যবান ভাই ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। অতঃপর জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আমাকে চতুর্থ আসমানে নিয়ে গেলেন আর দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল কে? তিনি বললেন আমি জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে-কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে দাওয়াত করা হয়েছে? জিব্্রাঈল আলাইহিস সালাম বললেন- হ্যাঁ। এবার আওয়াজ এল, তাঁর প্রতি সাদর সম্ভাষণ, তাঁর শুভাগমন কতইনা উত্তম ও বরকতময়! এ বলে দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর আমি সেখানে পৌঁছা মাত্রই সাক্ষাৎ হল হযরত ইদ্রীস আলাইহিস সালাম এর সাথে । জিব্রাইল আলাইহিস সালাম বললেন, ইনি হযরত ইদরীস আলাইহিস সালাম, আপনি তাঁকে সালাম প্রদান করুন। আমি
সালাম প্রদান করলাম। তিঁনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, পুণ্যবান ভাই ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। অতঃপর জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আমাকে পঞ্চম আসমানে নিয়ে গেলেন আর দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল কে? তিনি বললেন আমি জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে-কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে দাওয়াত করা হয়েছে? জিব্্রাঈল আলাইহিস সালাম বললেন- হ্যাঁ। এবার আওয়াজ এল, তাঁর প্রতি সাদর সম্ভাষণ, তাঁর শুভাগমন কতইনা উত্তম ও বরকতময়! এ বলে দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর আমি সেখানে পৌঁছা মাত্রই সাক্ষাৎ হল হযরত হারূন আলাইহিস সালাম এর সাথে । জিব্রাইল আলাইহিস সালাম বললেন, ইনি হযরত হারূন আলাইহিস সালাম, আপনি তাঁকে সালাম প্রদান করুন। আমি সালাম প্রদান করলাম। তিঁনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, পুণ্যবান ভাই ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। অতঃপর জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আমাকে ষষ্ঠ আসমানে নিয়ে গেলেন আর দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল কে? তিনি বললেন আমি জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে-কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে দাওয়াত করা হয়েছে? জিব্্রাঈল আলাইহিস সালাম বললেন- হ্যাঁ। ওই ফিরিশতা বললেন, তাঁর প্রদি সাদর সম্ভাষণ, তাঁর শুভাগমন কতইনা উত্তম ও বরকতময়! এ বলে দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর আমি সেখানে পৌঁছা মাত্রই সাক্ষাৎ হল হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এর সাথে । জিব্রাইল আলাইহিস সালাম বললেন, ইনি হযরত মূসা আলাইহিস সালাম, আপনি তাঁকে সালাম প্রদান করুন। আমি সালাম প্রদান করলাম। সালামের জবাব দিয়ে
বললেন, পুণ্যবান ভাই ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। অতঃপর আমি যখন তাঁকে অতিক্রম করে অগ্রসর হলাম তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। তাঁকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমার পরে এমন একজন পবিত্র যুবককে (নবীরূপে) পাঠানো হল, যাঁর উম্মতের সংখ্যা আমার উম্মতের সংখ্যার চেয়ে অধিক পরিমাণ বেহেশতে প্রবেশ করবে। অতঃপর জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আমাকে সপ্তম আসমানে নিয়ে গেলেন আর দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হল কে? তিনি বললেন আমি জিব্রাঈল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সাথে-কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে দাওয়াত করা হয়েছে? জিব্্রাঈল আলাইহিস সালাম বললেন- হ্যাঁ। ওই ফিরিশতা বললেন, তাঁর প্রতি সাদর সম্ভাষণ, তাঁর শুভাগমন কতইনা উত্তম ও বরকতময়! এ বলে দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর আমি সেখানে পৌঁছা মাত্রই সাক্ষাৎ হল হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এর সাথে । জিব্রাইল আলাইহিস সালাম বললেন, ইনি আপনার পিতা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম, আপনি তাঁকে সালাম প্রদান করুন। আমি সালাম প্রদান করলাম। সালামের জবাব দিয়ে বললেন, পুণ্যবান পুত্র ও পুণ্যবান নবীর প্রতি সাদর সম্ভাষণ। অতঃপর আমাকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত উঠানো হলো। সিদরা বৃক্ষের ফল ছিল হাজর অঞ্চলের মটকার ন্যায় এবং তার পাতা হাতির কানের ন্যায়। জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম বললেন, এটাই সিদরাতুল মুনতাহা। সেখানে চারটি নহর ছিল। দু’টি অপ্রকাশ্য অন্য দু’টি প্রকাশ্য। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিব্রাঈল, এ নহরের তাৎপর্য কী? তিনি বললেন, অপ্রকাশ্য নহর দুটো হল জান্নাতের দু’টি ঝর্ণাধারা। আর প্রকাশ্য দু’টি হল (মিসরের) নীল ও (ইরাকের) ফোরাত নদী। অতঃপর বাইতুল
মা’মুরকে আমার সম্মুখে প্রকাশ করা হল। তারপর আমাকে দেয়া হল একপাত্র শরাব, একপাত্র দুধ ও একপাত্র মধু। আমি দুধই গ্রহণ করলাম। জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম বললেন, এটাই স্বভাবজাত ধর্ম (ইসলাম)’র নিদর্শন। আপনি এবং আপনার উম্মত দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। তারপর আমার উপর দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হল। যখন আমি ফিরে চললাম তখন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্বত নামায পড়তে সক্ষম হবে না। খোদার কসম! আপনার পূর্বে আমি লোকদেরকে পরীক্ষা করে দেখেছি এবং বনী ইসরাঈলের সাথে আমি কঠোর নীতি অবলম্বন করেছি। অতএব, আপনি আপনার রবের কাছে আবার ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের জন্য নামায কমিয়ে দেয়ার আবেদন করুন। অতঃপর আমি আবারো আল্লাহর কাছে গেলাম। আমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক দশ ওয়াক্বত নামায কমিয়ে দিলেন। তারপর আমি মূসা আলাইহিস সালাম- এর নিকট এলাম। তিনি এবারও অনুরূপ বললেন, আর আমি পুনরায় আল্লাহর নিকট গেলাম আর আবেদন করলাম; তিনি আবারো দশ ওয়াক্বত কমিয়ে দিলেন। তারপর মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে ফিরে এলে তিনি আবারো অনুরূপ বললেন। আমি আবার আল্লাহর কাছে ফিরে গেলাম। পরিশেষে আমাকে প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্বত নামাযের আদেশ দিলেন। আমি মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে ফিরে এলাম। তিনি আমার উপর আদিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে আমি পাঁচ ওয়াক্ত সময়ের কথা বললাম, অতঃপর তিনি বললেন, আপনার উম্মত দৈনিক পাঁচ ওয়াক্বত নামাযও পড়তে সক্ষম হবে না। আপনার পূর্বে আমি লোকদেরকে পরীক্ষা করে দেখেছি এবং বনী ইসরাঈলের প্রতি কঠোর নীতি অবলম্বন করেছি। তাই আপনি পুনরায়
আপনার প্রতিপালকের দরবারে গিয়ে আপনার উম্মতের জন্য (নামায) আরো হ্রাসের আবেদন করুন! নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমি আমার মহান রবের কাছে কয়েকবার (নামায হ্রাস করার) আবেদন করেছি। আমার লজ্জাবোধ হচ্ছে। অতএব এখন আমি এতটুকুতেই সন্তুষ্ট এবং আমার প্রতিপালকের আদেশে আনুগত্য প্রকাশ করছি। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমি মূসা আলাইহিস সালামকে অতিক্রম করে অগ্রসর হলাম। তখন জনৈক আহ্বানকারী আওয়াজ দিয়ে বললেন, আমার আদেশ আমি জারি করে দিলাম এবং আমার বান্দাদের জন্য তা লঘু করে দিলাম।
[বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড ৫৪৮ পৃঃ]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা ঃ
মি’রাজ রজনীতে স্বচক্ষে আল্লাহর দীদার লাভ ঃ
হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করতে শুনেছেন- যখন কোরাইশরা মি’রাজের ঘটনার ব্যাপারে আমাকে অস্বীকার করতে চাইল তখন আমি মকামে হিজরে দাঁড়ালাম আর আল্লাহ পাক বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে আমার সামনে উপস্থাপন করলেন। আমি সেই বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে দেখে দেখে তাদের সকল প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলাম।
[বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ ও মিশকাত শরীফ]
মি’রাজ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্যতম মু’জিযা। এ মু’জিযা সংঘটিত হয়েছিল নবী-ই আকরামের নবুয়্যত প্রকাশের ১১ বছর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায়।
নুবূয়্যতের একাদশ বর্ষের পবিত্র রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতের অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সৌরজগত, সিদরাতুল মুন্তাহা, আরশ-কুরসী ভ্রমণ করে লা-মকানে খোদার সাথে দীদার লাভ করে নব্বই হাজার কথাবার্তা শেষে পুনরায় মক্কা
শরীফে ফিরে এসে দেখলেন বিছানাও গরম রয়েছে আর ঘরের দরজার শিকলও নড়ছে। পরের দিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ বিষ্ময়কর মি’রাজের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন ক্বোরাইশ বংশের কাফিররা কোনমতেই তা বিশ্বাস করতে রাজি হলো না। বরং সরাসরি তারা মি’রাজের সত্যতাকে প্রত্যাখ্যান করল।
এদিকে আবু জাহেল হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বলল, “দেখো তোমাদের নবীর কান্ড। গত রাতেই নাকি তিনি সপ্ত আকাশ অতিক্রম করে আরশ-কুরসী পরিভ্রমণ করে আবার রাত শেষ হবার আগেই পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন। আসলে এটা কী করে সম্ভব?” জবাবে সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, নবীজী যদি এ কথা বলে থাকেন, তাহলে আমিই সর্বপ্রথম বিশ্বাস করলাম “মি’রাজুন্নবী সত্য।”
মি’রাজের বর্ণনা পবিত্র ক্বোরআনের সূরা বনী ইসরাঈলের শুরুতেই এসেছে_
পবিত্রতা তাঁরই জন্য, যিনি আপন (মাহবুব) বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত, যার আশেপাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই, নিশ্চয় তিনি শুনেন, দেখেন।”
মি’রাজকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ
১. মক্কা শরীফ হতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত। এ অংশকে বলা হয় ‘ইসরা’।
২. বায়তুল মুক্বাদ্দাস হতে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত। এ অংশকে বলা হয় ‘মি’রাজ’।
৩. সিদরাতুল মুন্তাহা হতে লা-মকান পর্যন্ত। এ অংশকে বলা হয় ‘ই’রাজ’।
সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকে মি’রাজুন্নবী বলা হয়।
অল্প সময়ে এ বিশাল জগত পরিভ্রমণ করে ফিরে আসা সত্যিই বিস্ময়কর। আল্লাহর কুদরত এবং নবী_ই আকরাম- এর মু’জিযা তথা অলৌকিক ক্ষমতার সামনে এটা একেবারেই স্বাভাবিক।
সাধারণ লোকের জন্য আশ্চর্যজনক মনে হবে বলেই আল্লাহ পাক কালামে মজীদে ‘সুবহানা’ শব্দ দিয়ে মি’রাজের বর্ণনা দিয়েছেন। ঈমানদার মাত্র এই কুদরতী শক্তিকে মেনে নেয়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মি’রাজ স্বপ্নের মাধ্যমে হয়েছিল, না স্বশরীরে হয়েছিল? এ বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা-বিশ্বাস ও ফতওয়া হল- নবী-ই পাকের মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল স্বশরীরে। কেবল স্বপ্নের মাধ্যমে মি’রাজ হলে এতে আশ্চর্যের কিছু থাকত না। আর কাফির-বেদ্বীনরাও এর বিরোধিতা করত না। কারণ, স্বপ্নের মাধ্যমে সাধারণতঃ অনেক কিছু দেখা যায়। সুতরাং মি’রাজ স্বপ্নের মাধ্যমে হয়েছে বললে নবী-ই পাকের এ মু’জিযার প্রকাশ হতো না।
‘আশ’আতুল লুম’আত’ কিতাবের ৪র্থ খন্ড ৫২৭ পৃষ্ঠায় শায়খই মুহাক্কিক হযরত আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন-“মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত ইসরা এবং মসজিদে আক্বসা হতে আসমান পর্যন্ত মি’রাজ। পবিত্র ক্বোরআনের দলিল দ্বারা প্রমাণিত ইসরা কেউ অস্বীকার করলে কাফির হয়ে যাবে আর হাদীসে মাশহুর দ্বারা প্রমাণিত মি’রাজ অস্বীকার করলে গোমরাহ হবে।”
শরহে আক্বাইদে নাসাফী’র ১০০ পৃষ্ঠায় রয়েছে-
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর মি’রাজ স্বশরীরে; জাগ্রত অবস্থায়। আসমানে পরিভ্রমণ অতঃপর সেখান থেকে আল্লাহর ইচ্ছায় ঊধর্্বলোকে গমন ও পরিভ্রমণ করা মাশহুর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং এটার অস্বীকারকারী বিদ’আতী হিসেবে গণ্য হবে।
শায়খ আহমদ মোল্লা জীওন রহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেন_
মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত মি’রাজ ‘পবিত্র কিতাবুল্লাহ’ দ্বারা প্রমাণিত, আসমান পর্যন্ত ভ্রমন ‘হাদীসে মশহুর’ দ্বারা প্রমাণিত আর তারও উপরে পরিভ্রমণ ‘খবরে আহাদ’ দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং প্রথমটাকে অস্বীকারকারী নিঃসন্দেহে কাফির, দ্বিতীয়টির অস্বীকারকারী বিদ’আতী আর তৃতীয়টির অস্বীকারকারী ফাসিক্ব। [তাফসীরাতে আহমদিয়া, ৩২৮ পৃঃ]
মোল্লা আহমদ জীওন রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাফসীরে আহমদিয়া’র ৩৩০ পৃষ্ঠায় আরো লিখেন_
বিশুদ্ধতম মত হল মি’রাজ রূহ বিশিষ্ট শরীর সহকারে সম্পন্ন হয়েছিল এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা এটিই। যারা মি’রাজকে কেবল রূহানী (আত্মিক) কিংবা স্বপি্নল বলে আক্বীদা পোষণ করে তারা বিদ’আতী, পথভ্রষ্ট এবং ফাসিক্ব।
নবীজীর শারীরিক মি’রাজ আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে আরো বেশি প্রমাণিত। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। সূর্য পৃথিবী হতে নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে। তাই সূর্য হতে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে প্রায় আট মিনিট। পবিত্র হাদীস শরীফের আলোকে প্রমাণিত চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র সবগুলো আমাদের প্রিয় নবীর নূর থেকে সৃষ্ট তথা নূরে মুহাম্মদীর একেকটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম শাখা। ক্ষুদ্রতম শাখার গতি যদি এত বেশি হয়, তাহলে মূল নূরের গতি কত হতে পারে তা সহজে অনুমেয়। তাই এক মুহুর্তে হাজার হাজার আলোকবর্ষ মাইল অতিক্রম করা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নূরানী সত্ত্বার জন্য একেবারেই সহজ। নবী-ই আকরাম স্বশরীরেই বিশাল নভোঃমন্ডল পার হয়ে লা-মক্বানে মহান আল্লাহর সাথে দীদার (সাক্ষাৎ) করেছেন এবং নব্বই হাজার কালাম করেছেন। যেমন- মিশকাত শরীফ ৬৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে হযরত আবদুর রহমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন-
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আমি আমার প্রতিপালককে অতি সুন্দর আকৃতিতে দেখেছি অতঃপর তিনি আমার দু’কাধের মধ্যখানে তাঁর কুদরতী হস্ত মুবারক রাখলেন। এতে আমি আমার বুকে শীতলতা অনুভব করলাম এবং আসমান-যমীনের মধ্যে যত কিছু রয়েছে সবকিছুই জেনে নিলাম।
এ হাদীস শরীফ থেকে দু’টি বিষয় পষ্কিার বুঝা যাচ্ছে। প্রথমতঃ মি’রাজের রজনীতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহ পাকের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন যে, মি’রাজের রজনীতে নবীজী জাহেরী চক্ষু দ্বারাই মহান রাব্বুল আলামীনের সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছিলেন। মি’রাজ হতে ফিরে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখতে পেলেন বিছানা এখনো গরম রয়েছে। ভোরে তিনি কাবাগৃহে তাশরীফ নিয়ে সকলের কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করলেন। আবু জাহল গং তথা ক্বোরাইশ দলপতিরা এ কথা শুনে পরীক্ষার ছলে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দরজা, জানালা ইত্যাদির বিবরণ জানতে চাইল। তারা এ কথাও জানত যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিপূর্বে কোনদিন বায়তুল মুক্বাদ্দাসে যাননি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সাথে সাথে জিব্রাঈল আমীনের মারফতে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পূর্ণ চিত্র নবী করিম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সামনে তুলে ধরলেন আর তিনি দেখে দেখে দরজা, জানালা ইত্যাদির বর্ণনা বিস্তারিতভাবে দিয়ে দিলেন। এতেও হতভাগা কাফিররা নবীজি মি’রাজকে বিশ্বাস করল না। পক্ষান্তরে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কোন প্রকার দলিল-প্রমাণ তালাশ ব্যতীত নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিলেন এবং নিরেট সত্য বলে ঘোষণা দিলেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন- হে আবু বকর মিরাজের ঘটনা এভাবে বিশ্বাস করলে কেন? উত্তরে আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটাতো সহজ বিষয়। এর চাইতেও অনেক বড় বিষয় না দেখে আপনার কথায় বিশ্বাস করেছি। যেমন মহান আল্লাহকেও তো স্বচক্ষে দেখিনি। আপনার কথার উপর বিশ্বাস করেই মহান আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি। সুতরাং আপনার কথায় বিশ্বাস রেখেই মি’রাজের সত্যতার উপর নিরঙ্কুশ সমর্থন দিলাম। উত্তর শুনে নবীজী খুশী হলেন, আর তাঁকে ‘সিদ্দীক্ব-ই আকবর’ উপাধীতে ভূষিত করলেন।

Comments

Popular posts from this blog

ছবছে আওলা ও আ'লা হামারা নবী।

পিডিএফ বই ২৮ টি একত্রে।

খাজা গরীবে নেওয়াজ এর জিবনী।