ধর্ম যার উৎসব তার।

ধর্ম যার উৎসব তার (পর্ব: ০১)
[শারদীয় উৎসব বা দুর্গোৎসব 'সার্বজনীন উৎসব' নয়]
-আবছার তৈয়বী
দুর্গোৎসব বলুন বা শারদীয় উৎসব বলুন, তা একান্তই হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব। তাও হিন্দু ধর্মের সকল গোষ্ঠির নয়, শুধুমাত্র 'বাঙালি হিন্দুদের'। তাহলে আমার প্রশ্ন- বাঙালি হিন্দুদের এই উৎসব কী করে আমাদের 'সার্বজনীন উৎসব' হতে পারে? কোন হিন্দু পুরোহিত বা কোন হিন্দু নেতা কি এই আজগুবি কথাটি বলেছেন? তাহলে আমরা কেন আগ বাড়িয়ে হিন্দুদের উৎসবকে 'সার্বজনীন উৎসব' বলে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে যাবো? আরে মশায়! যাদের উৎসব- তাদের করতে দিন, প্লিজ!  'লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন' (মর্মার্থ: যার যার ধর্ম তার তার) আয়াতটিকে 'বোখারি শরীফের হাদীস' বলে আপনারাই তো হাস্যকর প্রচারণা চালান। তাহলে যাদের ধর্মীয় উৎসব একান্তভাবে তাদেরকেই পালন করতে দিন। আর আমাদেরকেও আমাদের ধর্মটা সার্বিক ও নিরপদ্রুপভাবে পালন করতে দিন। নিজ নিজ ধর্ম নির্বিঘ্নে, পরিপূর্ণভাবে এবং স্বাধীনভাবে পালন করা প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকারে হস্তক্ষেপ যেমন কাম্য নয়, তেমনি একের ধর্ম ও ধর্মীয় উৎসব নানা ফন্দি-ফিকিরে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়াও সমীচিন নয়। এতে উভয় ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি নয়; বরং ক্যাঁচালই বাড়বে।

বাংলাদেশে 'দুর্গাপূজা' আসলে বিভিন্ন মহল থেকে লাগাতারভাবে বিভিন্ন রঙে, বিভিন্ন ঢঙে এবং বিভিন্ন বাক্যে 'বাণী' আসতে শুরু করে। ইদানিং একটি বাণী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে জোরে-শোরে প্রচার করা হচ্ছে, তা হলো- 'ধর্ম যার যার উৎসব সবার'। ইদানিং এর সাথে যুক্ত হয়েছে- 'শারদীয় উৎসব বা দুর্গোৎসব সার্বজনীন উৎসব' নামে একটি আজগুবি কথা!  এই কথাগুলো পবিত্র ইসলামের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। কারণ, দূর্গাপূজা মূলত: মূর্তিকেন্দ্রিক একটি পূজা। এখানে শুধু নারী মূর্তিই নয়, সাথে নর মূর্তি, সিংহ মূর্তি, ময়ুর মূর্তি, হাতি মূর্তি, সাপ মূর্তি ও রাক্ষস মূর্তি বানিয়ে পূজা করা হয়। উইকিপিডিয়ার ভাষ্যমতে, "দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হল হিন্দু দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি উৎসব। এই পূজা মূলতঃ বাঙালি হিন্দু উৎসব"। অকালবোধন, শারদোৎসব, বিজয়াদশমী, দশহরা নামেও এর পরিচিতি আছে। ভারতে প্রধানতঃ বাংলা, অসম, ত্রিপুরা, বিহারসহ বিভিন্ন রাজ্যে উদযাপিত হয়। বাংলাদেশে সরকারি আনুকূল্যে এটি বেশ ঘটা করেই পালন করা হয়। এতে ফি বছর বাংলাদেশ সরকার বিরাট অংকের বাজেট দিয়ে থাকে। এটি প্রথানুসারে পনেরো, দশ বা পাঁচ দিনে সম্পন্ন হয়। এতে যে সব পূজা পালন করা হয়, তা হলো- দুর্গাষষ্ঠী: বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস; মহাসপ্তমী: নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন, সপ্তম্যাদিকল্পারম্ভ, সপ্তমীবিহিত পূজা; মহাষ্টমী: মহাষ্টম্যাদিকল্পারম্ভ, কেবল মহাষ্টমীকল্পারম্ভ, মহাষ্টমীবিহিত পূজা, বীরাষ্টমী ব্রত, মহাষ্টমী ব্রতোপবাস, কুমারী পূজা, অর্ধরাত্রবিহিত পূজা, মহাপূজা ও মহোৎসবযাত্রা সন্ধিপূজা ও বলিদান; মহানবমী: কেবল মহানবমীকল্পারম্ভ, মহানবমী বিহিত পূজা; বিজয়াদশমী: বিজয়াদশমী বিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, বিসর্জন, বিজয়াদশমী কৃত্য ও কুলাচারানুসারে বিসর্জনান্তে অপরাজিতা পূজা। দুর্গাপূজার সাথে সম্পর্কিত আরো কয়েকটি পূজা হলো- মহালয়া, দশহরা, জগদ্ধাত্রী পূজা। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন- দুর্গাপূজা কিন্তু একটি মাত্র পূজা নয়। এটি অন্ততঃ ২৫ টি পূজার সমাহার! 

আর মূর্তিপূজার ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান সুস্পষ্ট। আল্লাহর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাহবিহী ওয়া সাল্লামা ইরশাদ করেছেন- "আল্লাহ আমাকে বিশ্বজগতের কল্যাণকারী হিসেবেই পাঠিয়েছেন। আর আমার প্রভু আযযা ও জাল্লা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন- মূর্তি ধ্বংস করতে।" (মুসনাদে আহমদ) আল্লাহর রাসূল (দরুদ) যখন পবিত্র মক্কায় আভির্ভূত হন- সে সময় খোদ কা'বা ঘর ও তার আশে-পাশে ৩৬০ টি মূর্তি স্থাপন করে মক্কার কাফির ও মুশরিকরা পূর্জা-অর্চনা করছিল। আল্লাহর রাসূল (দরুদ) শুরু থেকেই মক্কার কাফিরদের এই অবস্থা দেখে খুবই ব্যথিত হন। নবুওয়ত প্রকাশের শুরুতেই আল্লাহর রাসূল (দরুদ) মক্কার কাফিরদেরকে দীনের দাওয়াত দিতে শুরু করলে এই প্রথম মক্কাবাসীরা সদলবলে তাঁর বিরোধিতা করতে শুরু করে। কেন এই বিরোধিতা জানেন? তিনি বলতেন, 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্' (আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল)। এই কলেমার দাওয়াতটি মূলতঃ মূর্তিপূজার বিরোধী।

এই দাওয়াত প্রচার করার সাথে সাথেই এতোদিনের বিশ্বস্থ (আল আমিন) ও সত্যবাদী (আস সাদিক) মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা মক্কার কাফিরদের চক্ষুশূল হয়ে গেলেন! তারা এতোদিন হাতেগড়া যে মূর্তিগুলোর পূজা করে আসছিল- তাওহীদ ও রিসালাতের এই কলেমা একেবারে কাফিরদের বোধ ও বিশ্বাসের মর্মমূলে আঘাত হানে। এতোদিনের চিরবন্ধু এখন হয়ে গেলো- চিরশত্রু। ব্যক্তিগত কারণে নয়, শুধু মানুষের হাতে গড়া নানা কিম্ভুতকিমাকার ও চিত্র-বিচিত্র উপাস্যদের বাদ দিয়ে এক আল্লাহর ইবাদাত করতে বলাটাই তাঁর অপরাধ (?)। তাঁর চিরচেনা আশেপাশের মানুষগুলো হয়ে গেলো তাঁর চির দুশমন। প্রিয় ভাই, বোন ও বন্ধুগণ! আপনারা কি ব্যাপারটা ভেবে দেখেছেন? মক্কার কাফির-মুশরিকদের কাছে মুহম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা) দোষ (?) বলতে আর কিছুই না- শুধু মূর্তিপূজা করতে নিরোৎসাহিত করা ও নিষেধ করা। এই নিষেধ করাটাকেই তারা তাদের হাতেগড়া খোদার প্রতি গালি হিসেবে নিজ থেকেই ধরে নিল। যদিওবা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা জীবনে কখনো কাউকেই গালি দেননি। তিনি তাঁর স্বভাব-সুলভ হৃদয়াগ্রাহী ভাষায়, ভদ্র ব্যবহারে এবং বিনয়ী আচরণে মক্কার কাফির-মুশরিকদেরকে এক আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য বলতেন। তাঁর এই সুন্দর কথাগুলোও কাফির-মুশরিকদের অন্তরে খেজুর কাঁটা হয়ে বিঁধতো। উল্টো তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝাতেন- "মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাই আমাদের! ভাতিজা আমাদের! তুমি আমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত, তুমি আমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত, তুমি আমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি বিশ্বস্থ, তুমি আমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি সত্যবাদী  এবং তুমি আমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি পুণ্যবান। দেখো- তুমি তোমার এক খোদার ইবাদত কর- ভালো কথা, কিন্তু খবরদার! আমাদের খোদাগুলো সর্ম্পকে নেতিবাচক প্রচারণা করো না। এর পরও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাহবিহী ওয়াসাল্লামা এক আল্লাহর প্রতি দীনের দাওয়াত দেয়া অব্যাহত রাখলে মক্কার কাফির-মুশরিকরা এবার ভিন্ন কায়দায় ব্ল্যাকমেইল করতে চাইলো। তারা বললো- হে আমাদের বিশ্বস্থ পুণ্যবান লোক! এক কাজ করো- তুমি একদিন আমাদের খোদাগুলোর পুজা করো আর একদিন আমরা তোমার খোদার পূজা করবো"।

প্রিয় পাঠক/পাঠিকা! আপনারা ভেবে দেখুন- 'ধর্ম যার যার উৎসব সবার' ও  দুর্গাপূজা 'সার্বজনীন উৎসব' বলার মাঝে মক্কার কাফির-মুশরিকদের কথার প্রতিধ্বনি আছে। কিন্তু কাফির-মুশরিকদের এই মিশ্রিত ধর্মপালনের প্রস্তাবটি বাহ্যিক দৃষ্টিতে নির্বিরোধী শান্তি প্রস্তাব মনে হলেও এটা যে দীন বিরোধী একটি চরম ধোঁকাপূর্ণ প্রস্তাব- তা সাথে সাথেই আল্লাহ পুরো একটি সূরা নাযিল তাঁর নবীকে জানিয়ে দেন। আল্লাহ বলেন, "ক্বুল্ ইয়া আইয়ুহাল্ কা-ফিরূনা। লা আ’বুদু মা তা’বুদূনা। ওয়ালা আনতুম্ আ'-বিদূনা মা আ’বুদ্। ওয়ালা আনা আ'-বিদুম্ মা-আ'বাততুম্। ওয়ালা আনতুম্ আ'-বিদূনা মা আ’বুদ্। লাকুম্ দীনুকুম্ ওয়ালিয়া দীন্"। অর্থাৎ ' হে রাসূল (দরুদ)! আপনি বলুন- "হে অবিশ্বাসীরা! তোমরা যার পূজা করো- আমি তার ইবাদাত করি না। আর আমি যার ইবাদাত করি- তোমরা তার ইবাদাতকারী নও। আর তোমরা যার পূজা করছো- আমি তার ইবাদাতকারী হবো না। আর আমি যার ইবাদাত করি- তোমরা তার ইবাদাতকারী হবে না। তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আর আমার জন্য আমার দীন (সার্বিক জীবন ব্যবস্থা)। (সূরা কাফিরুন: ১-৬)

এখন আপনারাই বলুন- হিন্দুধর্মেরর কিছু গোষ্ঠির দুুর্গাপূজাকে সার্বজনীন উৎসবের নাম দিয়ে মুসলিম ছেলে-মেয়েদের তাতে অংশগ্রহণের প্ররোচনা দেয়া এবং 'পঞ্চগব্য' মিশ্রিত প্রসাদ খেতে প্রলুব্ধ করা- কতোখানি যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? প্রিয় ভাই, বোন ও বন্ধুগণ! আপনার অজান্তে আপনার ছেলে-মেয়ে বা ভাই-বোন দুর্গাপূজায় গিয়ে সার্বজনীন উৎসবের নামে মস্তিতে মেতে উঠছে না তো? কিংবা আপনি নিজেই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে শারদীয় উৎসবে গিয়ে গোগ্রাসে দুর্গাপূজার প্রসাদ গিলছেন না তো?

বি.দ্র.: প্রসাদ কী দিয়ে তৈরি হয়, প্রসাদের উপাদান 'পঞ্চগব্য' কী,  দুর্গাপূজার উৎপত্তি ও বিকাশ, মূর্তিপূজার ইতিহাস এবং আদি হিন্দু ধর্মে যে মূর্তিপূজাই নেই- সেই চমকপ্রদ ইতিহাস জানতে চোখ রাখুন- আগামী পর্বগুলোতে।

পুনশ্চ: দীন ও ঈমানের স্বার্থে শেয়ার করুন এবং কপি পেইস্ট করে অবিকৃতভাবে নিজ নিজ টাইমলাইন থেকে পোস্ট করুন।

তারিখ:১০ অক্টোবর, ২০১৮ খৃ.
আবুধাবি, ইউ.এ.ই।

Comments

Popular posts from this blog

ছবছে আওলা ও আ'লা হামারা নবী।

পিডিএফ বই ২৮ টি একত্রে।

খাজা গরীবে নেওয়াজ এর জিবনী।