মোটিভেশনাল স্টোরী!
বোয়ালখালী উপজেলার হালিম লিয়াকত স্মৃতি বৃত্তি স্মারক ১৮ এর জন্য লিখিত মোটিভেশনাল ষ্টোরী মহামানবের পথযাত্রা।
মহামানব কিভাবে হওয়া যায় তার বিস্তারিত। নতুন প্রজন্মের সবাইকে বলবো কষ্ট হলেও একটু পড়ুন। হয়তো নতুন কিছু জানবেন।
#মহামানবের পথযাত্রা#
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলো, ফজরের আযান হয়েছে কিছু সময় আগে। দূরের দিগন্তে পাহাড়ের ফাঁক বেয়ে লাল আভার খেলা। শীতল বাতাসে প্রান জুড়িয়ে যাচ্ছে, মনে হয় যদি এমনি সুন্দর বাতাসে সারাজীবন দোল খেতে পারতাম,তাহলে হয়তো জীবনে আর খুব বেশী চাওয়া পাওয়ার থাকতোনা। পৃথিবীর অবারিত সৌন্দর্য আমি দুচোখ ভরে দেখছি, জগতের সব আলোর মায়া আমাকে ঘিরে ধরেছে।
ছবির মত সুন্দর পরিপাটি জাপানের বড় এই শহর নাগোয়া। বছর খানেক আগে বৈজ্ঞানিক গবেষনা ও পিএইচডির উদ্দেশ্যে আমার আসা। এ শহরের আলো বাতাসে অনেক শুদ্ধতা, রাস্তায় গাড়ির বিন্দুমাত্র হর্ণ নেই, নেই ধূলোবালি আর যানজটের কোন লেশমাত্র। রাত গভীর কিংবা সন্ধ্যায় নিরাপদে বাড়ি ফিরতে কোন অসুবিধা নেই নারী কিংবা পুরুষ কারোই। ভয় নেই পকেটমার, হাইজ্যাকার কিংবা অন্য কোন বিপদের। কোন সমস্যা হলে ১ মিনিটের মাথায় উপস্থিত হবে পুলিশ, অবশ্যই পুলিশকে আপনি পাবেন আপনার একান্ত অনুগত সেবক হিসাবে, কি চাই আপনার, কোন ধরনের সাহায্যের দরকার এরজন্য সদা সর্বদা তারা প্রস্তুত।
এতো নিরাপদ আর ছবির মত সুন্দর শহরে থেকেও মনে ভীষন হাহাকার জন্মে ঐ গিঞ্জি আর যানযটের শহর ঢাকার জন্য। এখানকার নির্মল বাতাসের চেয়ে বেশী মনে পড়ে সেই পল্লী গাঁয়ের একটু দমকা হাওয়া। এতো আধুনিক আর নির্মল শহর আমাকে টানেনা। বার বার ফিরে যাই আমার সোনার বাংলায়। আর এই যে ফিরে যাওয়ার যে আকুতি তার নামই দেশপ্রেম।
দেশের প্রতি মায়া অনুভব করা যায় যখন আমরা দেশ থেকে বহুদূরে চলে আসি। বহুবার নানা প্রয়োজনে বিদেশের মাটিতে গিয়েছি, নতুন দেশের নতুন নতুন সব জিনিস দেখে শিহরিত হয়েছি ঠিকই, কিন্তু কদিন পরেই মন চলে যেতো বাংলা মায়ের কাছে। আর তাই সব ফেলে আমি ছুটে গিয়েছি মাতৃভূমির পানে। কিন্তু এবারের আগমন খুব বেশী সময়ের জন্য, তাই প্রতীক্ষা স্বদেশের মাটিতে কবে ফিরে আসবো। এ দূর দেশের মানুষগুলোকে বলতে চেয়েছি তোমাদের শিশা আর দস্তা মুক্ত নির্মল বাতাসে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমি ফিরে যেতে চাই আমার সেই প্রিয় মাতৃভূমিতে।
একটি সত্য গল্প বলি শুনুন, রাসুল দঃ মক্কায় কালেমার দাওয়াত দিতে গিয়ে নানাভাবে আক্রান্ত। সকাল বিকাল আক্রমনের শিকার হতে হচ্ছে প্রিয় নবীকে। একদিন আল্লাহ্ তায়লা নির্দেশ দিলেন হে আমার প্রিয় বন্ধু আপনি মদিনায় চলে যান। গভীর রাতে বহুদিনের পরীক্ষিত সাথী আবু বকর রাঃ কে নিয়ে রাসুল দঃ রওয়ানা হলেন ইয়াসরেব তথা মদিনার পানে। রাসুল দঃ আল্লাহ্র নির্দেশে অনেকদূর চলে এসেছেন মক্কা থেকে, কিন্তু অনেক দূরের ওই পাহাড় থেকে মক্কা নগরীর একটি ঘরে প্রদিপের আলো দেখা যাচ্ছিলো। রাসুল দঃ পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে ভর করে দৌড়াচ্ছেন, আর একটু পর পর মক্কার দিকে তাকাচ্ছেন। তাঁর দুচোখ অশ্রুসিক্ত, মাঝে মাঝে সে অশ্রু রাসুলের দঃ নুরানী গাল বেয়ে বুকের কাছে চলে আসছে। শুধুমাত্র আল্লাহ্র দ্বীনকে বিজয়ী করতে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে আসা প্রিয় নবীর সে অশ্রু বর্ষন সেদিন আরশে মুয়াল্লায় এক করুন পরিবেশ তৈরী করেছে। হাজারো লাখো ফেরেশতা অশ্রসিক্ত হয়েছেন রাসুল দঃ এর দুঃখে। সেদিন প্রিয় নবী বলেছিলেন, হে আমার স্বদেশ, হে প্রিয় মক্কা, আমার জন্মভূমি, যদি আমার স্বজাতি আমার সাথে বেঈমানী না করতো তাহলে তোমাকে ছেড়ে আমি কখনো যেতাম না।
প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি রাসুলের এমন মায়া দেখে আরশে আজিমে বসে থাকা স্রষ্টা ওয়াদা করছিলেন, হে বন্ধু যে মক্কা থেকে ওরা আপনাকে বের করে দিয়েছি আমি আল্লাহ সে মক্কায় আপনাকে আবার ফিরিয়ে আনবো, এ মক্কার চাবী আমি আপনার হাতেই তুলে দেব। বহুবছর পর আল্লাহ্ তাঁর ওয়াদা পূর্ন করেছেন, প্রিয় নবীর হাতে মক্কার চাবি তুলে দিয়েছেন, সেই চাবী আজো আল্লাহ্ নবীর উত্তরসূরীদের হাতেই দিয়ে রেখেছেন।
আসলে দেশকে ভালোবাসা ঈমানের অংশ, যার মধ্যে দেশপ্রেম নাই, তারমধ্যে ঈমান নাই। দেশকে ভালোবাসি এটা মুখে বললেই ভালোবাসা হয়ে যায়না। আমাদের খুব দূর্ভাগ্য আমরা এমন একটা সময় অতিবাহিত করছি যখন ক্রিকেট খেলায় চারচক্কায় আনন্দ করা কিংবা পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়াকেই আমরা দেশপ্রেম মনে করি। অথচ একজন দেশপ্রেমিকের কাজ ছিলো আরো অন্যরকম। দেশ প্রেমিক হতে হলে আপনাকে সর্বপ্রথম নিজেকে যোগ্য দিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একজন সুশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ হয়ে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করার মাধ্যমেই দেশপ্রেমের প্রথম দীক্ষা। এরপর আসে দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ব বোধের দায়বদ্ধতা।
একজন সুনাগরিকের অনেক গুলো দায়িত্ব রয়েছে, যদি সে তা সঠিকভাবে পালন করে তবেই সে দেশপ্রেমিক। আর এ অভ্যাসগুলো গড়ে উঠে খুব ছোটবেলা থেকে। চিন্তা করে দেখুন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে আমরা পুরোটা ময়লার ভাগাড় বানিয়ে রেখেছি, জন্মের পর থেকে কেউ আমাদের শেখায়নি যে রাস্তার পাশে কিংবা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা অন্যায়, কেউ এসে বলেনি যে চাকুরীর বাইরে অবৈধ পথে আমরা যা আয় করি তাঁর নাম ঘুষ, আর ঘুষ জগন্যতম অপরাধ। যতদিন পর্যন্ত না এদেশে দূর্নীতি, মাদক ও হানাহানি রাহাজানি বন্ধ না হবে ততদিন আমরা হাজার চিতকার করলেও দেশপ্রেমিক হতে পারবোনা।
বিশ্বের সেরা বিদ্যাপীঠগুলো ব্যস্ত হাজার রকমের গবেষনা নিয়ে। এ পৃথিবীর বিজ্ঞানে দুনিয়ার উন্নত দেশগুলোর ছাত্রছাত্রীর অবদান রেখেই চলছে।অথচ প্রতিদিন প্রতিনিয়ত টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয় এমন কি কলেজেও হানাহানির ছবি দেখে আমাদের সকাল হয়।
কোন জাতি সাফল্যের চূড়ায় উঠতে হলে সে জাতিকে জ্ঞান বিজ্ঞান আর প্রজ্ঞায় এগিয়ে যেতে হবে তা না হলে সে জাতির উন্নয়ন সূদূরপরাহত। আমরা আমাদের নিজের অকর্মন্যতা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেই, আমরা ভাবি আমরা যা পাচ্ছি তাই আমাদের ভাগ্যে ছিলো। অথচ আল্লাহ্ তায়লা বলেছেন তিনি কোনদিন কোনজাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষন না সে জাতি চেষ্টা করে। আমাদের আসলেই চেষ্টা করতে হবে,তা না হলে আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন দূর্যোগ।
একজন ছাত্র যদি দেশপ্রেমিক হতে চায় তাহলে প্রথমে তাঁকে যা করতে হবে তা হলো নিয়মিত পড়াশোনা, এবং পড়াশোনাটা হতে হবে বুদ্ধিমত্তার সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমে, পাঠ্য বইয়ের বাইরে তাঁকে আরো অনেক সুন্দর সুন্দর বইয়ের সাথে পরিচিত হতে হবে। সাহিত্যের বই, কবিতার বই আর বিখ্যাত মানুষদের জীবনী নিয়মিত ভাবে কেউ যদি পাঠ করে, তাহলে তারমধ্যে গড়ে উঠবে একধরনের মানবিক বোধ। যে বোধের মাধ্যেম সে সমাজে ভবিষ্যতে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। একজন কবিতা প্রেমি মানুষ কোনদিন কারো অনিষ্ট করতে পারেনা, একজন বইপ্রেমী মানুষ কোনদিন অন্যায় করতে পারেনা।
একজন চাকুরীজীবী যদি দেশ প্রেমিক হতে চায় তাহলে তাঁকে প্রতিদিন সময়মত অফিসে আসতে হবে, কোন অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। একজন ব্যবসায়ী দেশপ্রেমিক হতে চাইলে তাকে মানুষের কথা ভেবে ব্যবসা করতে হবে, ভালো পন্য বিক্রি করার মাধ্যেম সমাজে সে অবদান রাখতে পারবে। আসলে দেশপ্রেমিকের আলাদা কোন সংজ্ঞা নাই। থাকা উচিতও নয়। আমরা সবাই নিজের দায়িত্বকে সঠিকভাবে পালন করলেই আমরা দেশপ্রেমিক।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে খুব বেশীদিন হয়নি, আমার বাংঙ্গালী জাতির ইতিহাসও খুব প্রাচীন নয়। এরমধ্যে কোনদিনই আমরা আমাদের নিজেদের শাসনভার কখনো নিজেদের হাতে পাইনি। আমাদের শাসন করেছে পালেরা, সেনেরা, মোঘলেরা, বৃটিশ কিংবা পাকিস্তানীরা। তাই আমাদের শাসনের অভিজ্ঞতা নেই, দেশ গড়ার অভিজ্ঞতা নেই, নগর গড়ার অভিজ্ঞতা নেই। এতো নাই এর মাঝে যুক্ত হয়েছে দূর্নিতী। সমাজের প্রতিটি স্তরে দূর্নিতি আমাদের ঝেঁকে বসেছে। এর থেকে বের হবার যেন কোন উপায় নেই। এতো কিছুর পরেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এখনো সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উন্নয়ন আর সুশাসন এ দুটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আগামী প্রজন্মকে অবদান রাখতে হবে।
অনেক অনেক কঠিন কথা বলার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। হয়তো অনেক কথা আগোছালো হয়ে গেলো। কিন্তু একটি সুর আপনাদের কানে হয়তো পৌছেছে সেটি হলো দেশপ্রেম মানে হলো নিজের কাজ সুন্দর করে করা।
ভোরের গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, আবার ভোরেই ফিরে যাই। আমার কাছে একটি সূর্য আছে, সেটি এখনো তেজদীপ্ত হয়নি। আমার কাছে একটি সুন্দর ভোর আছে সেটি এখনো প্রকাশিত হয়নি। আমি সে ভোরের দিকে তোমাকে ডাকছি, বহুকাল আমার ভোর আর ম্লান সূর্য শুধু তোমাদের প্রতিক্ষায় আছে।
বিশ্বখ্যাত মোবাইল কোম্পানী এপেল এর কর্নধার ষ্টিব জবস বলেছিলেন, “তুমি তোমার আজকের দিনটি এমনভাবে শুরু করো যেন মনে হয় আজকেই তোমার জীবনের শেষ দিন। এই শেষ দিনে তুমি যা যা করবে সেভাবেই প্রতিদিনের কাজগুলো করো” । মানুষ হিসেবে এ পৃথিবীতে আর আমাদের সুযোগ নেই, মানব জন্ম একবারই। এই একবারই এমন কিছু করো যাতে তোমার মৃত্যূর হাজার বছর পরেও মানুষ তোমাকে মনে করে, তোমার জন্য দুফোটা অশ্রুজলে সিক্ত হয়।
এ পৃথিবীর মাটি হাওয়া জলে একদিন আবার বরষার বৃষ্টি নামবে, এ পৃথিবীর রাত গুলোতে আবার রুপোর থালার মত পূর্নিমার চাঁদ উঠবে। এমন দিনে শুধু তুমি থাকবেনা, হয়তো দূরের কোন এক অজানা দেশে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেউ একজন তোমার জন্য অশ্রুসিক্ত হবে। মানুষ হিসেবে সেটিই হবে তোমার পরম পাওয়া। মনে রেখো এমন সুযোগ তোমার হাতে এখনো আছে।
তেজদীপ্ত সূর্য কিংবা মিষ্টি আলোর রুপোলী চাঁদ হয়ে মানুষের সমাজে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো। নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে যারা এটি করতে পেরেছে তারাই হয়েছে মহামানব। মনে রেখো মহামানব হবার সব সুযোগ তোমার এখনো আছে।
লেখকঃ ডাঃ শরীফ মহিউদ্দিন, পিএইচডি রিসার্চ ফেলো, মেডিসিন বিভাগ, আইচি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।
সাবেক পরিচালক, হালিম লিয়াকত স্মৃতি বৃত্তি পরীক্ষা।
Comments
Post a Comment