কারবালার ইতিহাস, পর্ব- ২১,২২,২৩।
কারবালার ইতিহাস (পর্ব-২১,২২,২৩)।
★হযরত অাব্বাস (র:) এর শাহাদাত
*******************
হযরত ইমাম (রাঃ) বোনের হাত ধরে জোর করে বোনকে নিয়ে তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। সেখানে গিয়ে আর এক দৃশ্য দেখলেন, তাঁর ছয় মাসের দুগ্ধ পোষ্য সন্তান হযরত আলী আছগর তৃষ্ণায় ছটফট করছিল এবং তাঁর জিহ্বা বের হয়ে গিয়েছিল। ছেলের মা বললেন, বাচ্চার এই অবস্থা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মুখ দিয়ে তাঁর কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। যে কোন প্রকারে ওর জন্য একটু পানি সংগ্রহ করুন। হযরত আব্বাস (রাঃ) পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এ কথা শুনে একেবারে ব্যাকুল হয়ে পড়লেনএবং বললেন, ভাইজান! আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুহূর্তে গিয়ে ফোরাত নদী থেকে পানি নিয়ে আসি এবং সেই পানি পান করিয়ে এ বাচ্চার তৃষ্ণা নিবারণ করি। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, ভাই! একটু সবর করো, সে জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করবে। কিন্তু হযরত আব্বাস (রাঃ) বললেন, ভাই! বড় পরিতাপের বিষয়। আমাদের বর্তমানে একটি মাছূম শিশু এভাবে তৃষ্ণায় মারা যাবে, তা কখনো হতে পারে না। আমরা কীসেই শেরে খোদার আওলাদ নই, যিনি খায়বারের বৃহৎ দরজা হাতের উপর তুলে নিয়েছিলেন? আমি কোন বাধা মানতে রাজী নই, এ মুহূর্তে পানি নিয়ে এসে এ মাছূম বাচ্চার তৃষ্ণা মিটাবো।অতঃপর মশক নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে তিনি ফোরাত নদীর দিকে ধাবিত হলেন এবং ফোরাত নদীর কাছে গিয়ে অতিদ্রুত ঘোড়া থেকে অবতরণ করে মশক ভরে পানি নিলেন এবং মুখ বন্ধ করে কাঁধের উপর উঠালেন এবং নিজ হাতে এক অঞ্জলি পানি মুখের কাছে নিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে তৃষ্ণার্ত ভাতিজার কথা মনে উদিত হলো। ভাতিজা যেন বললো, ‘চাচাজান! আপনার উচিত নয় যে, আমার আগে পানি পান করা। আপনি আলী আছগরের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পানি নিতে এসেছেন, নিজের জন্য নয়। প্রথমে আপনার মাছূম ভাতিজার তৃষ্ণা নিবারণ করান। এর পরেই আপনি পান করুন।’ শেষ পর্যন্ত হাতে নেয়া পানি ফেলে দিলেন এবং ঘোড়াকে নদীর কিনারা থেকে যখন উপরে উঠালেন, তখন ইয়াযীদের যালিম বাহিনীরা তাঁকে ঘিরে ফেলল। তিনি এ অবরোধ ভেদ করে অগ্রসর হলেন। ওরা পুনরায় অবরোধ করলো। তিনি এটাও প্রতিহত করলেন। এভাবে অবরোধ প্রতিহত করে ইয়াযীদীবাহিনীর অনেককেই জাহান্নামে পাঠিয়ে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন । কিন্তু তিনি ছিলেন একা আর ওরা ছিল চার হাজারেরও অধিক। ওরা পুনরায় চারিদিক থেকে ঘিরে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করতে লাগল এবং তাঁর শরীর তীরের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল। এভাবে তীরের আঘাতে যখন তাঁর শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে গেল, কাপুরুষ ইয়াযীদ বাহিনী বুঝতে পারলো যে, তিনি অনেক কাবু হয়ে গিয়েছেন। তাই নিকটবর্তী হয়ে পিছন দিক থেকে একজন তরবারীর আঘাতে তাঁর বাম হাত কেটে ফেলল। বাম হাত কেটে ফেলার ফলে মশক পড়ে যাচ্ছিল। শেরে খোদার আওলাদ তখনও সাহস হারাননি। তিনি মশক ডান কাঁধে নিয়ে নিলেন। সেই যালিমরা ডান হাতটাও কেটে ফেলল। মশক তখন পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেরে খোদার আওলাদ-এর হিম্মত দেখুন, তিনি দুই বাজু দিয়ে মশক আঁকড়িয়ে ধরলেন। এবার বাজুদ্বয়ও কেটে ফেলল কাফিররা। এখন এমন কিছু নেই যে ঘোড়ার লাগাম ধরবেন, এমন কোন হাত নেই যে তলোয়ার চালনা করবেন, এমন কিছু নেই যে মশক আঁকড়িয়ে ধরবেন।শেষ পর্যন্ত তিনি দাঁত দিয়ে মশকের মুখ কামড়িয়ে ধরলেন। যালিমরা তীর নিক্ষেপ করে মশক ফুটা করে দিল এবং পানি সব পড়ে গেল। এই অবস্থা দেখে তিনি দাঁতের কামড় থেকে মশক ছেড়ে দিলেন এবং বলতে লাগলেন, হে আলী আছগর! এ অবস্থায় আমি কিভাবে তোমার তৃষ্ণা নিবারণ করি? আমিতো তোমার তৃষ্ণা নিবারণে কামিয়াব হতে পারলাম না। তিনি ঘোড়ার উপর বসা অবস্থায় ছিলেন। ইয়াযীদী বাহিনীর সৈন্যরা তীরের আঘাতে উনাকে ঘোড়া থেকে মাটিতে ফেলে দিল এবং চারিদিক থেকে তলোয়ার দ্বারা আঘাত করতে লাগলো। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) দূর থেকে দেখলেন হযরত আব্বাস (রাঃ) ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে গেছেন। তখন উনি গুমরিয়ে কেঁদে উঠলেন এবং বললেন, ‘আমার কোমর ভেঙ্গে গেল।’ তিনি একেবারে বেকারার হয়ে পড়লেন। তাঁর সকল সঙ্গীরা চলে গেলেন এবং তাঁর ডান হাত হযরত আব্বাসও চলে গেলেন। এখন হযরত হুসাইন (রাঃ) একেবারে একা হয়ে গেলেন। তিনি আত্মহারা হয়ে তাঁর ভাইয়ের লাশেরকাছে ছুটে গেলেন। হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর দুই বাহু কাটা ছিল, শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল এবং সেই যালিমরা তাঁর মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছিল। লাশের কাছে পৌঁছে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, ভাই! তুমিতো আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, তোমার সাথে অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।’ অতঃপর ভাইয়ের রক্ত রঞ্জিত লাশ সেখানে ফেলে কেঁদে কেঁদে ফিরে আসলেন।
কারবালার ইতিহাস (পর্ব-২২)।
হযরত অালী অাকবর (র:) এর শাহাদাত
------------------------
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর শহীদী দেহ মুবারকের কাছ থেকে ফিরে এসে দেখেন,তাঁর আঠারো বছরের ছেলে হযরত আলী আকবর (রাঃ) যিনি আপাদমস্তক প্রিয় নবী (সঃ) এর প্রতিচ্ছবি ছিলেন, তিনিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে বললেন, আব্বাজান! আমাকেও বিদায় দিন। আমি চাই না, আপনার পর জীবিত থাকতে। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, বেটা শোন! তুমিতো মুস্তাফা (সঃ) এরই প্রতিচ্ছবি । তোমাকে যখন কেউ দেখে, দিলের তৃষ্ণামিটে যায়। তুমিতো আমার নানাজান (সঃ)এরই প্রতিচ্ছবি । তোমাকে দেখলেই আমার নানাজান (সঃ)এর আকৃতি সামনে ভেসে ওঠে। তোমাকে যদি আজ বিদায় দিই, আমাদের ঘর থেকে আমার নানাজান (সঃ)এর প্রতিচ্ছবি চলে যাবে। বাবা! তুমি যেয়ো না। ওরা আমারই রক্তের পিপাসু। আমার রক্তেরদ্বারাই ওদের পিপাসা নিবারণ হবে। কিন্তু হযরত আলী আকবর (রাঃ) বললেন, আব্বাজান! আমিও ওখানে যেতে চাই যেখানে আমার ভাই ক্বাসিম গেছেন, যেখানে আমার চাচাজান গেছেন। আমি কাপুরুষের মত পিছনে পড়ে থাকতে চাই না। আমিও জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ব্যাকুল। আমাকেও আপনার হাতে বিদায় দিয়ে জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে দিন। আমাকে যালিমদের হাতে সোপর্দ করে যাবেন না। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বাধ্য হয়ে তাঁর আঠারো বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বিদায় দিলেন।হযরত আলী আকবর (রাঃ) রওয়ানা হলেন। আল্লাহু ! আল্লাহ ! ইনি কে যাচ্ছেন?মুস্তাফা (সঃ) এর প্রতিচ্ছবি যাচ্ছেন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর জানের জান যাচ্ছেন। হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর বাগানের ফুল যাচ্ছেন। ইনি হুযূর (সঃ)এর বাগানেরফুলের কলি যাচ্ছেন। হযরত আলী আকবর যেতে যেতে এটা পড়তে ছিলেন- ﺍﻧﺎ ﻋﻠﻰ ﺑﻦ ﺍﻟﺤﺴﻴﻦ ﺑﻦ ﻋﻠﻰ + ﻧﺤﻦ ﺍﻫﻞ ﺍﻟﺒﻴﺖ ﺍﻭﻟﻰ ﺑﺎﻟﻨﺒﻰ .‘আনা আলিই-ইব্নুল হুসাইনিব্নু আলিইয়ি-নাহ্নু আহ্্লুল বাইতি আওলা বিন্নাবিইয়ি’অর
্থাৎ- ‘আমি আলী আকবর, হযরত হুসাইন (রাঃ)এর বেটা, যে হুসাইন (রাঃ) হযরত আলী মর্তুজা (রাঃ)এর বংশধর। আমরাই হলাম আহলে বাইত, রসূলে খোদা (সঃ)এর সবচেয়ে প্রিয় বংশধর।’এ ‘শে’র’ পড়তে পড়তে ইমাম আলী আকবর সামনে অগ্রসর হলেন এবং ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন, আমার দিকে লক্ষ্য করো! আমি ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর সন্তান। আলী আকবর আমার নাম। হে নবী পাক (সঃ)এর ঘরকে উজাড়কারী! হযরত ফাতিমাতুয্ যাহ্রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর বাগানের ফুল ও কলিসমূহকে কারবালার উত্তপ্ত বালিতে ছিন্ন-ভিন্নকারীরা! আমার রক্ত দ্বারাও তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো, আমার প্রতিও তীর নিক্ষেপ করো।’ হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) বলছেন, যালিমদের সাহস নেই, এ নওজোয়ানের প্রতি তীর নিক্ষেপ করার বা তরবারী চালানোর। আমর বিন সাআদ নিজ সৈন্যদেরকে বলল, হে কাপুরুষের দল! তোমাদের কি হলো? সত্ত্বর একেও বর্শায় উঠিয়ে নাও। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যে সকলের আগে এ নওজোয়ানকে কতল করতে পারবে, আমি তাকে ‘মোছিল’-এর রাজত্ব প্রদান করবো। এমন কোন ব্যক্তি আছে কি? যে মোছিলের শাসক হতে চায়? মোছিলের রাজত্ব পেতে চায়?তারিক বিন শিশ্ নামক এক বদবখত্ পালোয়ান ছিল। ওর মনে আমরের কথায় প্রভাব সৃষ্টি করল এবং সে আগে বাড়ল, দেখি ভাগ্যে মোছিলের গভর্নরগিরি আছে কিনা। সে তীর হাতে নিয়ে হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ)কে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। হযরত আলী আকবর (রাঃ) দৃঢ় স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। যখনই সে কাছে আসলো, হযরত আলী আকবর ঘোড়াকে ফিরায়ে ওর পিছনে এসে গেলেন এবং এমন জোরে আঘাত হানলেন যে একপলকে ওরমাথাকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।এই দৃশ্য দেখে ওর ছেলে উমর বিন তারিক রাগে প্রজ্জ্বলিত হয়ে তলোয়ার উচু করে এগিয়ে আসলো। যখন উভয়ের তলোয়ার একটার সাথে আর একটা আঘাতে ঝনঝনিয়ে উঠল, তখন যারাঅবলোকন করেছে তারা দেখছিল, ওর লাশ মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। দ্বিতীয় পুত্র তল্হা বিন তারেক সেও বাপ-ভাইয়ের খুনের বদলা নেয়ার জন্য অগ্নিশর্মা হয়ে হযরত আলী আকবর (রাঃ)এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হযরত আলী আকবর (রাঃ) একেও জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন। এ তিনজনকে হত্যা করার পর হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) ঘোড়া ফিরিয়ে তাঁর আব্বাজানের খিদমতে হাজির হলেন।হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) দেখলেন, তাঁর কলিজার টুকরা জিহাদের ময়দানথেকে আসছেন। তিনি এগিয়ে এলেন, এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা কি খবর! হযরত ইমাম আলী আকবর ঘোড়া থেকে অবতরণ করে আব্বাজানের কাছে আরজি পেশ করলেন। আব্বাজান! তৃষ্ণা খুব কষ্ট দিচ্ছে। খুবই তৃষ্ণা অনুভব করছি। যদি এক গ্লাস পানি পাওয়া যায়, তাহলে এদের সবাইকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিতে পারবো ইনশাআল্লাহ। আব্বাজান! আমি ওদের তিন বদবখত্ যোদ্ধাকে হত্যা করে এসেছি, কিন্তু আমার মুখ শুকিয়ে গেছে, আমার গলাও শুকিয়ে গেছে, আমারনিশ্বাসটাও সহজভাবে আসছে না। আমি খুবই কাহিল হয়ে গেছি।হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, প্রিয় বৎস! ধৈর্য ধারণ কর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি জান্নাতুলফিরদাউসে পৌঁছে যাবে এবং হাউজে কাওছারের পানি দ্বারা তোমার তৃষ্ণা মিটাবে। কিন্তু বাবা! তুমি যখন আমার কাছে এসেছ, এসো, হযরত ইমামহুসাইন (রাঃ) ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, মুখ খোল! হযরত আলীআকবর (রাঃ) মুখ খুললেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শুষ্ক জিহ্বা মুবারক ছেলের মুখের ভিতর প্রবেশ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার জিহ্বাটা চুষে নাও, হয়তো কিছুটা আরামবোধ করবে। হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর আব্বাজানের জিহ্বা চুষতে লাগলেন। জিহ্বা চুষে কিছুটা আরামবোধ করলেন।এরপর হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) পুনরায় জিহাদের ময়দানের দিকে এগিয়ে গেলেন। হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) জিহাদের ময়দানে প্রমাণ করে দিয়েছেন, তিনি শেরে খোদার দৌহিত্র। তাঁর শিরা-উপশিরায় হযরতআলী মর্তূজা (রাঃ)এর রক্ত রয়েছে এবং তাঁর চোখে হযরত আলী মর্তূজা (রাঃ) এর শক্তি কাজ করছে। তিনি আশি জন ইয়াযীদী বাহিনীকে হত্যা করে নিজে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে শাহাদাত বরণ করার আগ মুহূর্তে ডাক দিয়ে বললেন- ﻳﺎ ﺍﺑﺘﺎﻩ ﺍﺩﺭﻛﻨﻰ ‘ইয়া আবাতাহ! আদ্রিক্নী’অর্থাৎ ‘ওহে আব্বাজান! আমাকে ধরুন, আমাকে নিয়ে যান, আপনার আলী আকবর পড়ে যাচ্ছে।'এ আহবান শুনে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) দৌঁড়ে যান। তিনি ছেলের কাছে পৌঁছার আগে যালিমরা হযরত আলী আকবর (রাঃ)এর শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। জওয়ান ছেলের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি চোখের পানি ফেলছিলেন এবং অশ্রু সজল নয়নে তাঁর (রাঃ) এর জওয়ান ছেলের লাশ কাঁধে উঠিয়ে তাঁবুর পার্শ্বে নিয়ে আসলেন। হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর এ শাহাদাতে প্রত্যেকেই দারুণভাবে আঘাত পেলেন। হযরত যয়নাব (রাঃ) তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) এর লাশ দেখে চিৎকার করে বলে উঠলেন, আহ!যালিমরা প্রিয় নবী (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর প্রতিচ্ছবিকেও শেষ করে দিল। এ জালিমরা প্রিয় নবী করিম (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর চিহ্নকেও নিচিহ্ন করে দিল । নবী করিম (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর প্রতিচ্ছবিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিল ।
কারবালার ইতিহাস (পর্ব-২৩)
হযরত অালী অাসগর (র:) এর শাহাদাত
--------------------------
হযরত যয়নাব (রাঃ) ভাতিজা হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আহাজারি করতেছিলেন। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বোনের হাত ধরে তাঁবুর অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়েবললেন,বোন! ছবর করো, আল্লাহ তায়ালা ছবরকারীদের সাথে আছেন। ছবর এবং ধৈর্যের আঁচল হাতছাড়া করো না। যাকিছু হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা’র পক্ষথেকে হচ্ছে। আমাদের ছবর ও ধৈর্যেরমাধ্যমে কামিয়াবী হাছিল করতে হবে। এটা আল্লাহ তায়ালা’র পক্ষ থেকে মহাপরীক্ষা।বোনকে নিয়ে যখন তাঁবুর অভ্যন্তরেগেলেন, তখন হযরত শহরবানু (রাঃ) হযরতইমাম হুসাইন (রাঃ) উনার সামনে এসে বললেন,আপনার ছেলে আলী আছগর পানির তৃষ্ণায় কেমন যেন করছে, গিয়ে দেখুন। পানির তৃষ্ণায় তাঁর অবস্থা খুবই সঙ্গীন হয়ে গেছে। কোন রকম নড়াচড়া করতে পারছে না। কাঁদছে কিন্তু চোখে পানি আসছে না।মুখ হা করে আছে, কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেছে। শুনুন, যালিমেরা হয়তো জানে না যে, আমাদের সাথে ছোট ছোট শিশুরাও রয়েছেন। আমার মনে হয়, এ ছোট শিশুকে কোলে করে আপনি ওদের সামনে নিয়ে গেলে নিশ্চয় ওদের দিলে রহমহতে পারে। কারণ এ রকম শিশু ওদের ঘরেও রয়েছে। তাই আপনি এ শিশুকে কোলে করে ওদের সামনে নিয়ে যান এবং বলুন, আমাকে পানি দিও না, তোমাদের হাতে কয়েক ফোঁটা পানি এ শিশুর মুখে দাও। তাহলে তারা নিশ্চয় দিবে।হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন,শহরবানু! তোমার যদি এটা আরজু এবং ইচ্ছা হয়ে থাকে, তাহলে তোমার এ ইচ্ছা পূর্ণ করতে আমি রাজি আছি। কিন্তু ঐ বদবখ্তদের প্রতি আমার আদৌ আস্থা নেই।যা হোক, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ছয় মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশুকে কোলে নিয়ে ইয়াযীদ বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন,দেখ! এ ছয় মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশু। এ আমার ছেলে আলী আছগর। এ তোমাদের সেই নবী করীম ছল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বংশধর, তোমরা যার কলিমা পাঠ করো। শোন! আমিতোমাদের কোন ক্ষতি করে থাকলে, আমারথেকে তোমরা এর বদলা নেবে। কিন্তু এ মাছূম শিশুতো তোমাদের কোন ক্ষতিকরেনি। এ শিশু পানির তৃষ্ণায় ছটফট করছে, কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছে না। শোন! আমার হাতে কোন পানির পেয়ালা দিও না, তোমাদের হাতে এ শিশুর মুখে কয়েক ফোঁটা পানি দাও। আর এ শিশু পানি পান করারপর তলোয়ার হাতে নিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়বে না। তাই এর তৃষ্ণাটা নিবারণ করো। তাঁবুর পর্দানশীন মহিলাদের কাকুতি-মিনতিতে টিকতে না পেরে আমি একে নিয়ে এসেছি।তিনি (রাঃ) এ করুণ বর্ণনা দিচ্ছিলেন, আর এদিকে আলী আছগর (রাঃ)কে লক্ষ্য করে ‘হরমিলা বিন্ কাহিল’ নামক এক বদবখত্ যালিম তীর নিক্ষেপ করলো এবং সেই তীর এসে আলী আছগর (রাঃ)-এর গলায় বিধল। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) দেখলেন, শিশুটি একটু গা-নাড়া দিয়ে চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেল। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন, বলতে লাগলেন,ওহে যালিমেরা! তোমরাতো তোমাদের নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনার প্রতিও কোন সমীহ করলে না। তোমাদের মনতো কাফিরদের থেকেও কঠোর। শিশুদের প্রতি কাফিরেরাও সহানুভূতি দেখায়। তোমরাতো নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করো।তিনি (রাঃ) ছেলের গলা থেকে তীর বের করলেন এবং নিথর দেহ মুবারক মাটিতে রেখে বললেন,মাওলা! এ লোকেরা যা কিছু করছে, এর জন্য আমি আপনাকে সাক্ষ্য করছি।দেহ মুবারক কাঁধে করে তাঁবুর কাছে নিয়ে এসে হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর পাশে রেখে ডাক দিয়ে বললেন,ওহে শহরবানু! ওহে যয়নাব! আলী আছগরআর ছটফট করবেন না এবং তৃষ্ণার কারণে হাত পা নড়াচড়া করবেন না। উনার তৃষ্ণার্ত অবস্থা থেকে তোমাদের অস্থিরতা আর বৃদ্ধি পাবে না। সে জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে দাদীজান (রাঃ)এর কোলে বসে হাউজে কাওছারের পানি পান করছে।আহ ! কারবালার মাঠে হযরত ফাতেমাতুযযুহরা (রাঃ) এর বাগানের ফুল ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে রয়েছ । কোন জায়গায় আব্বাস (রাঃ) পড়ে রয়েছে, কোন জায়গায় কাসেম (রাঃ) পড়ে রয়েছে, কোন জায়গায় আলী আকবর (রাঃ) পড়ে রয়েছে, কোন জায়গায় আলী আসগর পড়ে রয়েছে।
তথ্য সূত্র - শামে কারবালা ও কারবালার প্রান্তরে।
লেখক - খতিবে পাকিস্থান অাল্লামা শফী উকাড়বী ।
Comments
Post a Comment