আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় সফর, সুফি মিজানুর রহমান।
এ দেশের ধর্মীয় চেতনার সাথে মিল রয়েছে মিশরের।দু দফা সফরের নানা দিক নিয়ে কথা বলেন সুফী মিজান
দৈনিক আজাদী
রবিবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ at ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ 65
কঠোর পরিশ্রম, অসাধারণ মেধা, সততা, নিষ্ঠা ও সেবার মিশেলে একজন মানুষ হয়ে উঠেন ‘ব্যক্তিত্বে’। নিজের কর্মোদ্যোগের ফলে দেশ ও সমাজের উন্নয়ন ঘটলে ওই ব্যক্তিই হয়ে উঠেন ‘উদাহরণ’। চট্টগ্রাম তথা সারাদেশে শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে এ ধরনের এক উদাহরণ হচ্ছেন সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। সফল মানুষের যে সংজ্ঞাই দেয়া হোক তিনি থাকবেন তাঁর অগ্রভাগে। তিনি এখন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান পিএইচপি গ্রুপ/ফ্যামিলির চেয়ারম্যান। ইংরেজি পিএইচপি শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘পিস হ্যাপিনেস অ্যান্ড প্রসপারিটি‘। যার অর্থ হচ্ছে ‘সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির ছায়া‘। প্রাণখোলা হাসি ও ব্যবহারে অসাধারণত্ব হলো তাঁর অন্যতম গুণ।
ইন্টারমিডিয়েট পাসের পরপরই ১৯৬৫ সালে সর্বপ্রথম তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে (বর্তমানে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড) চাকরি নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন তিনি। সেখানে দুই বছর চাকরি করার পর ’৬৭ সালেই আরেকটি ব্যাংকে যোগ দেন। তবে স্বাধীনতার পরপরই চাকরি ছেড়ে দিলেন। তখন ব্যবসার জন্য তার মূলধন ছিল মাত্র ১ হাজার ৪৮৩ টাকা। এই মামুলি টাকা দিয়েই ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। যা আজকে রীতিমত মহীরুহ। দেশের এ শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতির মতে, আল্লাহর অনুকম্পা, নিষ্ঠার সাথে কঠিন পরিশ্রম ও তপস্যা, সাধনা এবং নিয়তের সততা একত্রিত হলে বিধাতা তাকে উন্নত করবেই। কারণ এর সাথে মহাশক্তিধর বিধাতার করুণার স্রোতধারা মিশ্রিত থাকে।
সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ৯৪১ কিলোমিটার দূরে প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক মিশর সফর করেছেন দু’দফা। একান্তে কথা বলেছেন মিশরের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার সাথে। আলোচনা করেছেন বিভিন্ন ধর্মীয় ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। পিএইচপি চেয়ারম্যানের মিশর সফরের বিভিন্ন বিষয় সাক্ষাৎকার আকারে তুলে ধরা হল।
দৈনিক আজাদী : আপনার মিশর সফরের উদ্দেশ্য ও সেখানকার তৎপরতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করবেন?
সুফি মিজানুর রহমান : সাত সমুদ্দুর তের নদীর পাড় সুদূর মিশরে ৬ দিনের সফর ছিল। আমি আলাদা প্রতিনিধি দল নিয়ে ৬ আগস্ট থেকে দেড় মাসের মধ্যে দুইদফা মিশর সফরে ছিলাম।
সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দু’দেশের ধর্মীয় ও আত্মিক সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করা। কোন ব্যবসার উদ্দেশ্যে সেখানে যায়নি আমরা। কারণ মিশর হচ্ছে ধর্মীয় দিক থেকে একটি মধ্যমপন্থার দেশ। যেখানে সুফীবাদের চর্চা হয়। নবী রসুলদের জিকির হয়। অলি বুজুর্গদের অনুসরণ করা হয়। যা এদেশের ধর্মীয় চিন্তা চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ধর্মীয় জ্ঞান চর্চায় মিশরীয়রা কত সমৃদ্ধস্থানে রয়েছে তা দেখা এবং এদেশের আলেম সমাজের সাথে তাদের কিভাবে সেতুবন্ধন রচনা করা যায় উপলব্ধি করার জন্য এ ধরনের সফরের প্রয়োজন ছিল। কারণ এ মিশরেই আল–আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বপ্রাচীন জ্ঞানের আধার রয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান মুসলিম বিশ্বকে সমৃদ্ধ করছে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে।
সেখানকার তৎপরতা সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, আমরা আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। অনেক বড়বড় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও বুজুরগানেদ্বীনের সাথে কথা হয়েছে। জ্ঞানের আদান প্রদান হয়েছে। অনেক নবী, সাহাবা, বুজুরগানেদ্বীন ও অলির মাজার জিয়ারত করেছি। সফরের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ আলেম ওলামাদের সাথে জ্ঞানের আদানপ্রদানের মাধ্যমেই ব্যয় হয়েছে।
আজাদী : পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন আল–আজহার বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এখানকার শিক্ষার্থীদের জন্য কি তথ্য দেবেন?
সুফী মিজানুর রহমান : মিশর হচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্যের দেশ। অলি–আল্লাদের দেশ। নবী–রসুল ও সাহাবায়ে কেরামদের দেশ। এখানকার আল–আজহার বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম বিশ্বের মুরুব্বী প্রতিষ্ঠান হিসেবে হাজার বছর ধরে স্বীকৃত। এখানে ১৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছেন। এর মধ্যে ৪ লাখ আছেন বিভিন্ন দেশের। শিক্ষক রয়েছেন ৭০ হাজার। পৃথিবীতে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের সংখ্যা এত বেশী। পুরাতন আল–আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানে এখন মসজিদ রয়েছে। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১ হাজার ৬০ বছর। এখানে পড়তে শিক্ষার্থীদের কোন টিউশন ফি লাগেনা।
তিনি আরো বলেন, এখানে বাংলাদেশের স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছেন। ইন্দোনেশিয়ার রয়েছে ১৫ হাজারের মতো। সেখানে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই এসোসিয়েশনের নেতৃস্থানীয়দের সাথে আমরা মতবিনিময় করি। ‘মোয়াজ্জেমাম আল আজহারি’ নামে এ এসোসিয়েশনের নেতৃস্থানীয়দের সাথে মতবিনিময়ের প্রধান আলোচ্য ছিল কিভাবে আমাদের দেশের আলেম সমাজের সাথে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় তথা মিশরের আলেম সমাজের জ্ঞানের সংযোগ ঘটানো যায়? আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।
আজাদী : কার কার সাথে আপনাদের কথা হয়েছে?
সুফী মিজানুর রহমান: মিশরের গ্র্যান্ড মুফতি বা মিশরের সর্বোচ্চ ইমাম আহমদ শৌখি আল্লাম, শায়খুল আজহার বা ইমামুল আকবর প্রফেসর ড. আহমেদ তৈয়ব, বিশ্বের এক নম্বর ক্বারী আহমদ নায়না ও বিশ্বের তিন নম্বর আরবী ভাষায় পন্ডিত হাবিব জাফরীনসহ আরো কয়েকজন আলেম ও বুজুরগানেদ্বীনের সাথে আলোচনা হয়েছে। জ্ঞানের চর্চা হয়েছে। কিভাবে তাদের পান্ডিত্যে এদেশের আলেম সমাজকে বিশেষ করে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা সমৃদ্ধ আলেমদেরকে সমৃদ্ধ করা যায় সে বিষয় নিয়ে চর্চা হয়।
আজাদী : মিশরীয়দের ধর্মীয় ভাবধারার সাথে আমাদের ধর্মীয় ভাবধারার মেলবন্ধন কতটুকু?
সুফী মিজানুর রহমান : আল আজহারে সুফীবাদকে মানা হয়। আধুনিক ধর্মীয় চেতনা মধ্যমপন্থাকে মানেন তারা। জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদিতা, মওদুদীবাদ ও জামাত শিবিরীয় ভাবধারা সেখানে অনুপস্থিত। এখানে মানা হয় হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী তরিকাকে। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোন মওদুদীপন্থী কিংবা জামাতি ভাবাদর্শের ব্যক্তি শায়খুল আজহার বা আল আজহারের চ্যান্সেলর হতে পারেনি।
এখানে সত্যিকারের ইসলামকে ধারন ও পালন করা হয়। এ অবস্থায় আমার উপলব্ধিতে আসল আল আজহারের সাথে আমাদের একটা বন্ধন দরকার। জ্ঞান অর্জনের স্বার্থে। ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী আত্মস্ত করার উদ্দেশ্যে। আশার কথা হচ্ছে পরপর দুইটি সফরের মাধ্যমে দ্বি–পাক্ষিক সম্পর্ক আরো জোরদার হবে।
শায়খুল আজহার সম্পর্কে তিনি আরো জানান, শায়খুল আজহার মানে হচ্ছে ইমামুল আকবর বা শ্রেষ্ঠ ইমাম। যিনি আল আজহারের চ্যান্সেলর। যার ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রে সেদেশের প্রেসিডেন্টের উপরে। প্রেসিডেন্টের আদেশ উনি স্থগিত করতে পারেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট উনার আদেশ স্থগিত করতে পারেন না। উনার সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। আমরা উনাকে বাংলাদেশে আসার অনুরোধ জানিয়েছি। উনি সম্মতি দিয়েছেন।
আমরা উনাকে বলেছি, আপনি আমাদের দেশে আসলে ধর্মীয় দিক থেকে আমরা সমৃদ্ধ হবো। কারণ সৌদি আরব টাকা দিয়ে আমাদের দেশে ওহাবীবাদ ছড়াচ্ছে। জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। তবে উনার প্রটোকল যেহেতু প্রেসিডেন্টের তাই প্রেসিডেন্টকেই রিসিভ করতে হবে। উনি যখন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় গেছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট উনাকে রিসিভ করেছেন।
তিনি আরো জানান, মিশর কিংবা ওই অঞ্চলে অলিআল্লারা এদেশে ধর্মপ্রচার করতে এসে আমাদেরকে সমৃদ্ধ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আল আজহারীয় ভাবধারায় উজ্জল হতে দুইদেশের মধ্যে জ্ঞানের বিনিময় দরকার।
আজাদী : এদেশের মাদ্রাসায় পড়ুয়াদের আরবি শিক্ষায় আরো সমৃদ্ধ করে প্রকৃত ধর্মীয় চেতনা সম্পন্ন করতে কোন পদক্ষেপ আছে কি?
সুফী মিজানুর রহমান : আল আজহারের সাথে আমাদের ঐক্যতানের জন্য জ্ঞানের দরকার। জ্ঞান লাভের জন্য জ্ঞানী মানুষের সংস্পর্শ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জ্ঞানের সংস্পর্শ স্থাপনের জন্য আমাদেরকে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের সাহচর্য দরকার।
তিনি বলেন, তাদের সাথে তালমিলিয়ে নিজেরা সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য আমি চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরে আরবি ভাষা শিক্ষা সেন্টার করার উদ্যোগ গ্রহণ করছি। খুব শীঘ্রই এদেশের মানুষ এর বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পাবেন। এসব সেন্টারে এদেশের আরবি শিক্ষিতরা প্রশিক্ষন নেবে। তাদেরকে সমৃদ্ধ করতে আসবেন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদরা।
তিনি বলেন, বর্তমান যে শিক্ষাকার্যক্রম তাতে দক্ষ আলেম হওয়ার সুযোগ এদেশে কম। এত বিষয় একজন আরবি শিক্ষার্থীর সামনে থাকে। সবগুলোর উপর গুরুত্ব দেয়ার পর আরবিতে আর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়ে উঠেনা। ওহাবীবাদ, জঙ্গিবাদ ও মওদুদীবাদমুক্ত প্রকৃত ইসলামের জন্য লাগবে সত্যিকার আলেম। ভাল আলেম তৈরী করার জন্য প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, আর বিল্ডিং বানানো নয়। এবার মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য হাত দিচ্ছি প্রতিবছর আহলেসুন্নাত ওয়াল জামাতের ভাবধারা সম্পন্ন একশ’ শিক্ষার্থীকে আল আজহারে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। সেখানে ৪ মাসের একটি ইমাম প্রশিক্ষণ কোর্সও রয়েছে। এতেও আমরা অংশগ্রহণ করতে পারি।
আজাদী : জঙ্গিবাদের নামে হানাহানি এবং এ ধরনের জঙ্গিবাদ থেকে দেশকে নিরাপদ রাখার বিষয়ে আপনার পরামর্শ কি?
সুফী মিজানুর রহমান : অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মানুষের জীবনের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য নয়। জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল্যবোধ অর্জন ও জাগ্রত করা। অথচ আমরা সেটাই ভুলে গেছি।
তিনি বলেন, ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা–বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত এদেশকে ভালবাসতেই হবে আমাদেরকে। এ ভালবাসার জন্য অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও উগ্রবাদীতাকে কোনভাবেই মাথা তুলতে দেয়া যাবে না। দেশপ্রেমের চেতনা জাগ্রত করতে হবে।
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরকে তিনি প্রডাক্টিভ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, সরকারি উদারনীতির কারণে আজকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে ভাব বিনিময়ের সূত্রপাত ৫০ বছর আগে হলে আমরা ওহাবীবাদ ও জঙ্গিবাদমুক্ত ধর্ম চর্চায় অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম।
Comments
Post a Comment