কারবালার ইতিহাস।
কারবালার ইতিহাস (পর্ব -২,৩,৪)
পর্ব-----০২
শাহাদাতে কারবালা-----------------আল্লাহ্ তা'আলা ইরশাদ ফরমানযারা আল্লাহর রাস্তায় কতল বাশহীদ হয়ে যায় তাঁদের তোমরামৃত বল না । বরং তারা জীবিতকিন্তু তোমরা অবহিত নও ।অপর আয়াতে আল্লাহ্ পাকবলেনঃ ﻭﻻﺗﺤﺴﺒﻦ ﺍﻟﺬﻳﻦ ﻗﺘﻠﻮﺍ ﻓﻰ ﺳﺒﻴﻞ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻣﻮﺍﺗﺎ ﺑﻞ ﺍﺣﻴﺎﺀﻋﻨﺪ ﺭﺑﻬﻢ ﻳﺮﺯﻗﻮﻥ অর্থ: ‘যাঁরা আল্লাহতায়ালার রাস্তায় শহীদ হনতাঁদেরকে কখনও মৃত মনে করোনা। বরং তাঁরা নিজেদের রবতায়ালার নিকট জীবিত ওরিযিকপ্রাপ্ত।’— সূরা আলে ইমরান-১৬৯হুজুর (সঃ) এর উম্মতের মধ্যেঅনেকেই শাহাদাত বরন করেছেন। আল্লাহ্ তা'আলা অনেকলোককে এই নিয়ামত দানকরেছেন । যেমন, হযরত আবু বকরসিদ্দীক (রাঃ) এ নিয়ামত লাভকরেছেন । হযরত উমর ফারুক (রাঃ),হযরত উছমান গণি (রাঃ) ও হযরতআলী মরতুজা (রাঃ)ও এই নিয়ামতলাভে ধন্য হয়েছেন । জংগে উহুদ,বদর, গজওয়ায়ে খায়বরেও অনেকসাহাবায়ে কিরাম এ নিয়ামতলাভ করেছেন । কিন্তু হযরত ইমামহুসাইন (রাঃ) এর শাহাদত এমন একঅসাধারন ও অদ্বিতীয় শাহাদাতএবং এমন এক হৃদয় বিদারক ঘটনা,যার সাথে আগের ও পরের যুগেরকোন ঘটনার তুলনা হয় না ।(চলবে) ।
কারবালার ইতিহাস (পর্ব-৩)
ইয়াযীদের মসনদ দখল
-----------------------
হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (রাঃ)এর
ইন্তেকালের পর ইয়াযীদ
সিংহাসনে আরোহন করলো এবং
আরোহন করার সাথে সাথেই তার
মনের মধ্যে সীমাহীন অহঙ্কার ও
গর্ববোধের সৃষ্টি হলো। যার ফলে
সে এমন কাজ-কর্ম শুরু করলো, যা
মহান দ্বীনী শরীয়তের সম্পূর্ণ
বিপরীত। প্রায় মানুষ-ই ক্ষমতার
মোহে বিভোর হয়ে ধরাকে সরা
জ্ঞান করে। যেমন; ফিরআউন
প্রথমে গরীব ছিল, কিন্তু
ভাগ্যক্রমে বাদ্শা হয়ে
সিংহাসনে আরোহন করার সাথে
সাথে এমন অহঙ্কারী হয়ে বসলো
যে, শেষ পর্যন্ত নিজেকে খোদা
বলে ঘোষণা করলো এবং বলতে
লাগলো, ‘আমি তোমাদের
সবচেয়ে বড় খোদা’। আমার পূজা,
আরাধনা কর। সে-ই রক্ষা পাবে
যে আমার পূজা করবে। আর যে
আমার পূজা করতে অস্বীকার
করবে, তাকে আমি খতম করবো।
একমাত্র এ কারণেই সে অনেক
লোকের গর্দান দ্বিখন্ডিত
করেছিল। তাঁদের অপরাধ ছিলো,
তাঁরা তার পূজা করতেন না এবং
তাকে মা’বূদ মানতে অস্বীকার
করেছিলেন। তদ্রুপ ইয়াযীদও যখন
সিংহাসনে বসলো, তখন সে
বাপের বর্তমানে যে সব গর্হিত
কাজকর্ম গোপনে করতো, সে সব
এখন প্রকাশ্যে করতে লাগলো ।
যেহেতু এখন তাঁকে নিষেধ করা
বা বাঁধা দেয়ার কেউ নেই
সেহেতু সে এখন যা খুশি তা
করতে লাগলো । মদ্যপান, জেনা
এবং অন্যান্য কুকর্ম তাঁর নিত্য
দিনের অভ্যাসে পরিণত হল । সে
মনে মনে ভাবলো ‘আমার চাল-
চলন এবং স্বভাব-চরিত্র, তা কেউ
সহজে মেনে নিবে না । বিশেষ
করে যে সব গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ
আছেন তারা তাঁর এ রাজত্ব
মেনে নিবেন না; তারা তাঁর
হাতে বায়াত করবেন না; তাঁদের
অস্বীকৃতির কারনে অন্যদের
মধ্যেও অস্বীকৃতির প্রভাব
বিস্তৃত হবে । এজন্য এটাই
সমীচীন হবে যে, আমি তাঁদের
তলব করবো । যদি তারা
অস্বীকার করেন, তখন তাঁদেরকে
কতল করাবো, যাতে আমার
রাস্তার এ সব বড় বড়
প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হয় এবং
আমার খেলাফতের রাস্তা যেন
কণ্টকমুক্ত হয়ে যায় । তাই সে
ক্ষমতায় আরোহণ করার পর পরই
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ), হযরত
আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাঃ),
হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাঃ)
প্রমুখ থেকে বাইয়াত তলব করলো।
এসব ব্যক্তিগণ বিশেষ সম্মানিত
ব্যক্তি ছিলেন এবং বিশেষ
গণ্যমান্যদের বংশধর ছিলেন।
তাই তাঁরা কিভাবে ফাসিক-
ফাজির ইয়াযীদের হাতে
বাইয়াত করতে পারেন? সুতরাং
তাঁরা অস্বীকার করলেন এবং এটা
তাঁদের মর্যাদাগত সদাচরণই ছিল।
অস্বীকার করার পর হযরত
আব্দুল্লাহ বিন উমর রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু, হযরত আব্দুল্লাহ
বিন যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু মদীনা শরীফ
থেকে মক্কা শরীফে চলে
গেলেন।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) মদীনা
শরীফ-এর গভর্নর ওয়ালীদের
আহবানে তার দরবারে তাশরীফ
নিয়ে গেলেন, তার সঙ্গে
আলোচনা করলেন। মদীনার
গভর্নর বললো, ইয়াযীদ আপনার
বাইয়াত তলব করেছেন। তিনি
বললেন, ‘আমি ইয়াযীদের হাতে
বাইয়াত করতে পারি না।
ইয়াযীদ হলো ফাসিক-ফাজির, এ
ধরণের অনুপযুক্ত লোকের হাতে
আমি বাইয়াত করতে পারি না।
আমি কোন অবস্থাতেই ওর হাতে
বাইয়াত করতে রাজী নই।’ তিনি
সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করলেন।
এটা ছিল তাঁর মর্যাদাগত আচরণ।
দেখুন, তিনি যদি বাইয়াত
করতেন, তাহলে নিজের প্রাণ
বাঁচতো, পরিবার-পরিজন
বাঁচতো, হয়তো এমনও হতো যে,
অগাধ সম্পত্তির মালিকও তিনি
হয়ে যেতেন। কিন্তু ইসলামের
আইন-কানুন ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত
এবং কিয়ামত পর্যন্ত ফাসিক-
ফাজিরের আনুগত্য বৈধ হয়ে যেত
এবং তাদের কাছে হযরত ইমাম
হুসাইন (রাঃ)এর আনুগত্য প্রধান
দলীল হিসেবে পরিগণিত হতো।
লোকেরা বলতো, হযরত ইমাম
হুসাইন (রাঃ) যখন ফাসিক-
ফাজিরের আনুগত্য স্বীকার
করেছেন, তাহলে নিশ্চয়ই এটা
জায়িয।
কিন্তু ইমাম হুসাইন (রাঃ)
অস্বীকারের মাধ্যমে
বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করে
দিলেন, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)
শত দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে পারেন,
অনেক বিপদ-আপদের মুকাবিলা
করতে পারেন, এমন কী আপন
পরিজনের সমস্ত লোকদের
নির্দয়ভাবে শহীদ হওয়াটা
অবলোকন করতে পারেন; নিজেও
জালিমদের হাতে নির্মমভাবে
শাহাদাত বরণ করতে পারেন,
কিন্তু ইসলামের নিযাম বা
বিধান ছত্রভঙ্গ হওয়া কিছুতেই
সহ্য করতে পারেন না, নিজের
নানাজান (ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম)এর দ্বীন ধ্বংস
হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে
পারেন না। হযরত ইমাম হুসাইন
(রাঃ) নিজের কাজ ও কর্মপন্থা
দ্বারা তা প্রমাণ করেছেন এবং
দুনিয়াবাসীকে এটা দেখিয়ে
দিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালার
মনোনীত ও খাছ বান্দাগণের
এটাই শান যে, বাতিলের সামনে
বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং
তীর তলোয়ারের সামনে বুক
পেতে দেন, কিন্তু কখনও
বাতিলের সামনে মাথা নত
করেন না। হযরত ইমাম হুসাইন
(রাঃ) নিজের আমল দ্বারা তাঁর
উচ্চ মর্যাদার পরিচয় দান
করেছেন এবং জনগণের সামনে
নিজের পদমর্যাদা তুলে ধরেছেন।
কারবালার ইতিহাস (পর্ব-৪)
ইমাম হুসাইনের (র:) এর মক্কার উদ্দেশ্যে মদীনা ত্যাগ
--------------------------------------
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এভাবে ইয়াজিদের বেয়াদবীপূর্ণ প্রস্তাব অস্বীকার করে যখন ওর দরবার থেকে আপনজনদের কাছে ফিরে আসলেন এবং সবাইকে একত্রিত করে বললেন, আমার প্রিয়জনেরা! যদি আমি পবিত্র মদীনা শহরে অবস্থান করি, এরা আমাকে ইয়াযীদের বাইয়াত করারজন্য বাধ্য করবে, কিন্তু আমি কখনও বাইয়াত গ্রহণ করতে পারবো না। তারা বাধ্য করলে নিশ্চয়ই যুদ্ধ হবে, ফাসাদ হবে; কিন্তু আমি চাইনা আমার কারণে মদীনা শরীফে লড়াই বা ফাসাদ হোক। আমার মতে, এটাই সমীচীন হবে যে, এখান থেকে হিজরত করে মক্কা শরীফে চলে যাওয়া। নিজের আপনজনেরাবললেন, ‘আপনি আমাদের অভিভাবক; আমাদেরকে যা হুকুম করবেন তাই মেনে নেব।’ অতঃপর তিনি মদীনা শরীফ থেকে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আহ! অবস্থা কেমন সঙ্গীন হয়ে গিয়েছিলযে, ইমাম (রাঃ)কে সেই মদীনা শরীফ ত্যাগ করতে হচ্ছিল, যে মদীনা শরীফেতার(রাঃ) নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওযা শরীফ অবস্থিত। তাঁর নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা মুবারক যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার টাকা পয়সাব্যয় করে, আপনজনদের বিরহ-বেদনা সহ্য করে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করেদূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা আসে এই মদীনায়। কিন্তু আফসুস, আজ সেই মদীনা তিনি(রাঃ) ত্যাগ করছেন, যেই মদীনা শরীফ তারই(রাঃ) ছিল। নবীজী (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নয়নের তারা ছিলেন তিনি(রাঃ)। ক্রন্দনরত অবস্থায় তিনি(রাঃ) নানাজান (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর রওযা পাকে উপস্থিত হয়ে বিদায়ী সালাম পেশ করলেন এবং অশ্রুসজল নয়নে নানাজান(ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুমতি নিয়ে আত্মীয়-পরিজন সহকারে মদীনা শরীফ থেকে হিজরত করে মক্কা শরীফে চলে গেলেন। মক্কা শরীফ তিনি(রাঃ) কেন গিয়েছিলেন? আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ ফরমান- ﻭﻣﻦ ﺩﺧﻠﻪ ﻛﺎﻥ ﺍﻣﻨﺎ অর্থ: ‘যে হেরেম শরীফে প্রবেশ করলো, সে নিরাপদ আশ্রয়ে এসে গেল।’— সূরা আল ইমরান,আয়াত ৯৭কেননা হেরেম শরীফের অভ্যন্তরে ঝগড়া-বিবাদ, খুন-খারাবী নাজায়িযও হারাম। এমনকি হেরেম শরীফের সীমানায় উঁকুন মারা পর্যন্ত নিষেধ। তবে সাপ, বিচ্ছু ইত্যাদি মারতে পারে। কিন্তু যে সব পশু-পাখিমানুষের কোন ক্ষতি করে না সেগুলো মারা জায়িয নেই। মু’মিনদের ইজ্জত-সম্মান তাঁদের শান-মান এটাতো অনেক উচ্চ হয়ে থাকে। তাই ইমাম হুসাইন (রাঃ) চিন্তা করলেন যে, হেরেম শরীফের সীমানায় অবস্থান করে আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদত বন্দেগীতে বাকী জীবন কাটিয়ে দিবেন- এ মনোভাবনিয়ে তিনি মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফে চলে আসলেন।
(চলবে)।
Comments
Post a Comment