কারবালার ইতিহাস- ২৪- শেষ পর্ব।
কারবালার ইতিহাস (পর্ব-২৪,২৫,২৬ ও শেষ পর্ব)
হযরত ইমাম হোসাইন (র:) এর শেষ উপদেশ ও যুদ্বের ময়দানে গমন
--------------------------
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁবুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। তখন তাঁরচৌদ্দ বছর বয়স্ক ছেলে হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন (রাঃ), যিনি মারাত্মক রোগ ও জ্বরে ভুগছিলেন, হেলিয়ে দুলিয়ে কোন মতে আব্বাজানের সামনে এসে আরজ করলেন, আব্বাজান! আমাকেও বিদায় দিন, আমিওশাহাদাত বরণ করতে চাই। তিনি নিজের অসুস্থ ছেলেকে সান্ত্বনা দিলেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,যাইনুল আবিদীন! তোমাকেও যদি বিদায় দিই, তাহলে ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর ‘সিলসিলা’ কার থেকে জারি হবে? বাবা শোন! তোমার থেকেই আমার বংশের ‘সিলসিলা’ জারি হবে। আমি দুআ করছি, আল্লাহ পাক তোমাকে জীবিত রাখুন এবং তোমার থেকে আমার বংশধরের ‘সিলসিলা’ জারি রাখুন।তিনি উনাকে বাতিনী খিলাফত ও ইমামত প্রদান করলেন। উনাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে বাতিনী নিয়ামত প্রদান করলেন এবং কিছু ওছীয়ত করার পর ফরমালেন,প্রিয় বৎস! আমি চলে যাওয়ার পর মদীনা শরীফ-এ পৌঁছার যদি সৌভাগ্য হয়, তাহলে সবার আগে তোমার নানাজানছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা শরীফ-এ গিয়ে সর্বপ্রথমআমার সালাম বলিও এবং কারবালায় তোমার দেখা সমস্ত ঘটনা উনাকে শুনিও।ছেলেকে ওসীয়ত করার পর ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁর প্রস্তুতি শুরু করলেন, নবী করিম (সঃ) এর পাগড়ী মুবারক মাথার উপর রাখলেন, সৈয়দুশ শুহাদা হযরত হামযা (রাঃ) এর ঢাল পিঠের উপর রাখলেন । বড় ভাই হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) এর কোমর বন্ধনী নিজ কোমরে বাঁধলেন এবং আব্বাজান শেরে খোদা হযরত আলী মুর্তূজা (রাঃ) এর তলোয়ার ‘জুলফিকার’ হাতে নিলেন ।অতঃপর কারবালার দুলহা, কারবালার সুলতান শাহীন শাহে কারবালা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ময়দানের দিকে যাত্রা দিলেন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তলোয়ার হাতে নিয়ে বের হওয়ার মুহুর্তে সেই পর্দানশীন মজলুম মহিলাদের দিকে এক নজর তাকালেন, তখন সবাই তাঁকে (রাঃ) সবর ও ধৈর্যে অটল দেখালেন, কারো চোখে পানি নেই, সবাই অধিক শোকে পাথর হয়ে রইলেন । কিন্তু উনাদের অন্তর হু হু করে কাঁদছিল । যাদের ভরা ঘর আজ খালি হয়ে গিয়েছে । সর্বশেষ যেআশ্রয়টা ছিল, তিনি (রাঃ)ও এখন তাদেরকে বিদায়ী সালাম দিয়ে রওয়ানা হচ্ছেন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এক এক জনকে সম্বোধন করে বললেন,‘শহরবানু’ আমার আখেরী সালাম গ্রহণ করো, ‘রোবাব ! হুসাইন (রাঃ) এর চেহারা দেখে নাও, সম্ভবতঃ এ চেহারাদেখার নসীব আর নাও হতে পারে । জয়নাব! তোমার ভাই যাচ্ছে, জয়নাব!তুমি খয়বার যুদ্ধ বিজয়ীর কন্যা, তুমি ধৈর্যশীলা ফাতিমাতুয যুহরা (রাঃ) এর কন্যা, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ সবরকারী (সঃ) এর আওলাদ । দেখ, এমন কোন কাজ করিও না, যদ্বারা আল্লাহ ওতাঁর রাসূল (সঃ) নারাজ হন । যে কোন অবস্থায় ধৈর্যহারা হইওনা । জয়নাব! আর একটি কথা শোন, আমার প্রিয় কন্যা সখিনাকে কাঁদতে দিওনা । সে আমার সব চেয়ে আদরের মেয়ে । ওকে আদর করিও এবং সদা বুকেজড়িয়ে রাখিও । আমি যাচ্ছি, তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে সোপার্দ করলাম ।তিনি (রাঃ) এ কথাগুলো বলছিলেন, আর এদিকে তাঁর মাসুম কন্যা এসে জড়িয়ে ধরলো । হযরত রোবাব (রাঃ) এসে হযরত হুসাইন (রাঃ) এর কাঁধে মুখরেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন,আমাদেরকে ফেলে আপনি কোথায় যাচ্ছেন, এ দুর্দিনে আমাদেরকে এ অবস্থায় ফেলে কোথায় যাচ্ছেন ? জালিমদের হাতে আমাদের সোপর্দ করে কোথায় যাচ্ছেন ? আমাদের পরিণাম কি হবে! এ পশুরা আমাদের সাথে কি যে আচরণ করবে! তিনি (রাঃ) বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের সাথে আছেন ।তোমরা আল্লাহর নবী (সঃ) এর আওলাদ, আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত । আল্লাহ তাআলা তোমাদের ইজ্জত সম্মানের হেফাজতকারী ।হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) সবাইকে ধৈর্য ধারণের জন্য তাগিদ দিলেন । কিন্তু নিজে অধৈর্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলেন । তবুও একান্ত কষ্টে আত্ম সংবরণ করে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ঘর থেকে বের হয়েনিজের ঘোড়ার কাছে আসলেন এবং যে মাত্র ঘোড়ায় আরোহন করতে যাচ্ছিলেন, সে মূহুর্তে হযরত সৈয়দা জয়নাব (রাঃ) মাথায় পর্দা দিয়ে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন,ভাইজান! যে মায়ের তুমি দুধ পান করেছ, আমিও সে মায়ের দুধ পান করেছি, আমিও হযরত আলী মর্তুজা (রাঃ) এর কন্যা । ভাইজান! তুমি সবাইকে ঘোড়ায় আরোহন করিয়ে ময়দানে পাঠিয়েছ, কিন্তু তোমাকে আরোহণ করার মত এখন আর কেউ নেই । তাই এ মজলুম বোন তোমাকে ঘোড়ায় আরোহন করাবে । আমি তোমার ঘোড়ার লাগাম ধরলাম, তুমি আরোহণ কর ।হযরত হুসাইন (রাঃ) ঘোড়ায় আরোহণ করে ময়দানের দিকে যাত্রা শুরু করলেন । হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (রাঃ) এর নয়নমণি ইয়াজিদী বাহিনীরসামরা সামনি হতে চলেছি । নবী করিম (সঃ) এর দৌহিত্র পরিবারের সবার শাহাদাত বরণ করার পর নিজে শাহাদাত বরণ করতে চলছেন।
কারবালার ইতিহাস (পর্ব-২৫)।
হযরত ইমাম হোসাইন (র:) এর বীর বিক্রম অাক্রমন
-------------------------
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন,দেখ, আমি কে? আমি হলাম জান্নাতের যুবকদের সাইয়্যিদ। আমি ঐ হুসাইন, যাঁকে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুমু দিতেন এবং বলতেন, এটা আমার ফুল। আমি ঐ হুসাইন যাঁর মা ফাতিমাতুয্ যাহরা (রাঃ)। আমি ঐ হুসাইন যাঁর পিতা হযরত আলী মর্তূজা (রাঃ), যিনি খাইবর বিজয়ী। আমি ঐ হুসাইন, যার নানা আল্লাহর নবী খাতেমুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সঃ) । আমি ঐ হুসাইন, যখন আল্লাহর নবী (সঃ) সিজদারত অবস্থায় থাকতেন, আমি পিঠ মুবারকের উপর সওয়ার হয়ে যেতাম আর তখন উনি সিজদাকে দীর্ঘায়িত করতেন। ওহে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ঘর উচ্ছেদকারীরা! ওহে হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (রাঃ) বাগানের ফুলকে ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন করে কারবালার উত্তপ্ত বালিতে নিক্ষেপকারীরা! এসো, আমার রক্তের দ্বারাও তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো। কি দেখছ ? আমার পিছনে আর কেউ নেই। একমাত্র আমিই রয়েছি। এগিয়েএসো।তখন ওরা তলোয়ার খাপ থেকে বের করে তীর উত্তোলন করে এগিয়ে আসলো। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) যখন খাপ থেকে তলোয়ার বের করে ওদের উপরআক্রমণ করলেন, তখন ওরা মেষের পালেরমত পালাতে লাগলো। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এমন বিদ্যুৎ বেগে ওদের উপর তলোয়ার চালাতে লাগলেন যে ওদের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে এমনভাবে পতিত হতে লাগলো যেমন শীতকালে বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়ে। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) অল্প সময়ের মধ্যে লাশের স্তূপ করে ফেললেন। তিনি (রাঃ) নিজে তীরের আঘাতে জর্জরিত এবং তিনদিনের তৃষ্ণায় কাতর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর তলোয়ার ‘যুলফিকার’ তখনও সেই নৈপুণ্য দেখিয়ে যাচ্ছিল, যেভাবে বদরের যুদ্ধে দেখিয়েছিল। বদরের যুদ্ধে এ তলোয়ার যখন শেরে খোদা হযরত আলী (রাঃ) এর হাতে ছিল এবং চালানো হচ্ছিল, তখন অদৃশ্য থেকে আওয়াজ আসছিল-লা ফাতা ইল্লা আলী, লা সাইফা ইল্লাযুল্ফিকারঅর্থাৎ ‘ হযরত আলী (রাঃ) এর মত যেমন কোন জওয়ান নেই, তেমনি ‘যুলফিকার’-এর মত কোন তলোয়ার নেই।এখনও সেই তলোয়ার সেই নৈপুণ্য দেখাচ্ছিল। মোট কথা, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) লাশের স্তুপ করে ফেলেছেন। ইয়াযীদী বাহিনীকে কেটে কেটে মাটি রঞ্জিত করে ফেললেন। একদিকে তিনি যেমন অনেক ইয়াযীদী সৈন্যকে কচুকাটা করলেন, অন্যদিকে ওরাও তাঁকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেললো।
কারবালার ইতিহাস (পর্ব-২৬)।
হযরত ইমাম হোসাইন (র:) এর শাহাদাত
--------------------------
নিজেদের মারাত্মক পরিণতির কথা উপলব্ধি করে আমর বিন সা’আদ নির্দেশ দিল, সবাই মিলে চারিদিক থেকে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করো। নির্দেশমত ইয়াযীদী বাহিনী নবী (সঃ) এর দৌহিত্রকে চারিদিক থেকে ঘিরে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করতে লাগলো। ফলে চারিদিক থেকে তীর এসে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে আঘাত হানতে লাগলো। কোনটা ঘোড়ার গায়েওলাগছিল, কোনটা তাঁর নিজের গায়ে পড়ছিল। এভাবে যখন তীরের আঘাতে তার পবিত্র শরীর ঝাঁঝরা হয়ে ফিনকি দিয়ে সারা শরীর থেকে রক্ত বের হতে লাগলো, তখন তিনি (রাঃ) বার বার মুখে হাত দিয়ে বললেন, বদবখতেরদল! তোমরাতো তোমাদের নবী পাক (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর লেহাজও করলে না। তোমরানিজের নবী (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বংশধরকে হত্যা করেছ । এভাবে যখন তিনি আর একবার মুখের উপর হাত দিলেন, তাঁর চোখের সামনে আর এক দৃশ্য ভেসে উঠল। তিনি দেখতে পেলেন, স্বয়ং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতে একটি বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হযরত আলী মর্তুজা (রাঃ) ও হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (রাঃ)ও পার্শ্বে আছেন আর বলছেন,হুসাইন! আমাদের দিকে তাকাও, আমরা তোমাকে নিতে এসেছি।হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কাপড় রক্তে ভিজে যাচ্ছিল আর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই রক্ত বোতলে ভরে নিচ্ছিলেন এবং বলছিলেন,হে আল্লাহ পাক! হুসাইনকে পরম ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দান করুন।আল্লাহ্ ! আল্লাহ্ ! নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৌহিত্র নিজের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলেন। শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়ে একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গেলেন এবং আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন। যে মুহূর্তে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন, আল্লাহ পাকের আরশ দুলিয়ে উঠলো, ফাতিমাতুয্ যাহরা (রাঃ) এর আত্মা ছটফট করতে লাগলো, হযরত আলী (রাঃ)এর রূহ মুবারক থেকে ‘আহ’ শব্দ বের হলো। সেই হুসাইন (রাঃ) পতিত হলেন, যাকে প্রিয় নবী ছল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের কাঁধে নিতেন। ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার পর কমবখত্ সীমার, হাওলা বিন ইয়াযীদ, সেনান বিন আনাস প্রমুখ বড় বড় জালিম এগিয়ে আসলো এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর শরীরের উপর চেপে বসলো। সীমার বুকের উপর বসলো। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বুকের উপর সীমারকে দেখে বললেন, আমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিকই বলেছেন,এক হিংস্র কুকুর আমার আহলে বাইতেররক্তের উপর মুখ দিচ্ছে’, আমার নানাজান (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কথা মুবারক ষোল আনা সত্য, তুমিই আমার হত্যাকারী। আজ জুমার দিন। এ সময় লোকেরা আল্লাহ পাকের দরবারে সিজদারত। আমার মস্তকটা তখনই আমার শরীর থেকেবিচ্ছিন্ন করো, যখন আমিও সিজদারত থাকি।আহ ! দেখুন, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) জীবন সায়াহ্নের সেই মুহূর্তেও পানি পান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি, নিজের ছেলেমেয়েকে দেখার জন্য আরজু করেননি, সেই সময়ও কোন আকাঙ্খা বা আরজু থাকলে এটাই ছিল যে, আমার মাথা নত হলে যেন আল্লাহ পাকের সমীপেই নত হয়। সে সময়ও তিনি (রাঃ) বাতিলের সামনে মাথা নত করেন নি । সে সময়ও তিনি (রাঃ) সিজদা করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন, নামায পড়ে দেখিয়েছেন, দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, হুসাইন (রাঃ) আঘাতে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও নামায ত্যাগ করেন নি । তিনি (রাঃ) দুনিয়াবাসীকে এটাই যেন বলতে চেয়েছিলেন, আমাকে যদি ভালবাসেন, আমার জিন্দেগী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) সিজদায় মাথা রাখলেন এবং ﺳﺒﺤﺎﻥ ﺭﺑﻰ ﺍﻻﻋﻠﻰ ‘সুবহানা রব্বিইয়াল আ’লা’ তাসবীহ পাঠ করে বললেন,মাওলা! যদি হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কুরবানী আপনার দরবারে গৃহীত হয়, তা’হলে এর ছওয়াব (নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উম্মতের উপর বখশিশ করে দাও ।হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর মস্তক মুবারক যখন শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল, তখন তাঁর ঘোড়া স্বীয় কপালকে তাঁর (রাঃ) রক্তে রঞ্জিত করল এবং দৌড়ে চলে যেতে লাগল, তখন সীমার লোকদেরকে বলল, ঘোড়াটিকে ধরো, কিন্তু যতজন লোক ঘোড়াটি ধরতেএগিয়ে গেল, সে সবাইকে আক্রমণ করল এবং দাঁত আর পা দিয়ে জখম করে ওদেরকে শেষ করে দিল। সতের জন লোককেএভাবে খতম করল। শেষ পর্যন্ত সীমার বলল, ছেড়ে দাও, দেখি কি করে? ঘোড়াছুটে গিয়ে তাঁবুর কাছে গেল এবং কান্না ও চিৎকার করতে লাগলো।
কারবালার ইতিহাস ( শেষ পর্ব)
হযরত ইমাম হুসাইন
(রাঃ) এর লাশের
পার্শ্বে হযরত
সৈয়দা যয়নাব
(রাঃ) ও হযরত
সখিনা (রাঃ)
-------------------------------
হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) যখন
ঘোড়ার কান্না ও চিৎকার
শুনলেন, তখন তিনি হযরত সখিনা
(রাঃ)কে ডেকে বললেন, বেটি!
একটু দাঁড়াও, আমি বের হয়ে দেখে
আসি, সম্ভবতঃ তোমার আব্বা
এসেছেন। মজলুম বোন বের হয়ে
দেখলেন, ঘোড়ার জীন খালি
এবং ঘোড়ার কপাল রক্তে
রঞ্জিত। তা দেখে হযরত যয়নাব
(রাঃ) বুঝতে পারলেন, হযরত ইমাম
হুসাইন (রাঃ) শাহাদাত বরণ
করেছেন এবং তিনি চিৎকার
দিয়ে বলে উঠলেন-
ﻭﺍﻩ ﺣﺴﻴﻨﺎ ‘ওয়াহ্ হুসাইনা’ ﻭﺍﻩ ﻏﺮﻳﺒﺎ
‘ওয়াহ্ গরীবা।’
তাঁর এ আওয়াজ শুনার সাথে
সাথে তাঁবুর অভ্যন্তরে ক্রন্দনের
রোল পড়ে গেলো। হযরত যয়নাব
(রাঃ) ডাক দিয়ে বললেন,
শহরবানু! সখিনাকে থামিয়ে
রেখ, আমি ভাইয়ের খবর নিতে
যাচ্ছি। হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা
(রাঃ)এর কন্যা হযরত যয়নাব
(রাঃ), যার মাথার ওড়নাও কোন
অপরিচিত ব্যক্তি কখনো
দেখেনি, যিনি ঘরের চৌহদ্দি
থেকে কখনো বের হননি, আজ
পরদেশে অসহায় অবস্থায় মুখের
উপর পর্দা ফেলে ভাইয়ের
লাশকে দেখার জন্য কারবালার
ময়দানের দিকে ছুটে চললেন।
যেতে যেতে তিনি বলতে
লাগলেন,
'ওহে যালিমেরা! পথ ছেড়ে দাও,
আমার ভাইকে দেখতে দাও।’
ওরা বলল, তুমি ওকে কি দেখবে ?
ওর মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন
করে ফেলা হয়েছে।
হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) গিয়ে
ভাইয়ের লাশকে জড়িয়ে ধরে
কাঁদতে লাগলেন, আর বলতে
লাগলেন, ভাইজান! তুমিতো
আমাদেরকে যালিমদের হাওলা
করে চলে গেলে।
আল্লাহ্ ! আল্লাহ্ !হযরত ইমাম
হুসাইন (রাঃ) এর নিস্প্রাণ দেহ
মুবারক কারবালার যমীনে পড়ে
রইল। যেসব লোকেরা হযরত ইমাম
হুসাইন (রাঃ) এর লাশ দাফন
করেছিলেন, তারা বলেছেন যে,
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর
শরীরে চৌঁত্রিশটি বর্শার ছিদ্র
, চল্লিশটা তলোয়ারের আঘাত
এবং একশত একুশটি তীরের জখম
ছিল। হযরত সৈয়দ যয়নাব (রাঃ)
নিজের ভাইয়ের লাশ মুবারকের
পাশে বিভোর হয়ে পড়ে রইলেন;
এদিকে হযরত সৈয়দা সখিনা
(রাঃ), হযরত সৈয়দা শহরবানু
(রাঃ) থেকে নিজেকে মুক্ত করে
কারবালার ময়দানের দিকে
অঝোর নয়নে ক্রন্দনরত অবস্থায়
ছুটে গেল এবং চিৎকার করে বলতে
লাগলো, ফুফু! তুমি কোথায়? আব্বু
আমার কোথায়? আওয়াজ শুনে ফুফু
ডাক দিলেন, বেটি! এদিকে এসো,
তোমার মজলুম ফুফু তোমার আব্বুর
পাশে বসে আছে। হযরত সৈয়দা
সখিনা (রাঃ) যখন নিজের
আব্বাজানকে দেখলো, চিনতে
পারলো না। কারণ তাঁর (রাঃ)
সমস্ত শরীর মুবারক রক্তে
রঞ্জিত ছিল এবং মস্তক মুবারক
শরীর থেকে বিছিন্ন ছিল।
মা’ছুমা সখিনা আব্বাজানের
লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেহুঁশ
হয়ে গেল। হযরত সৈয়দা যয়নাব
(রাঃ) হযরত সখিনার হাত টেনে
ধরে বলল, মা সখিনা! ওঠ, আমি
তোমাকে তাঁবুতে দিয়ে আসি।
আমার ভাই, আমাকে বলেগেছেন
যে, তোমাকে সান্ত্বনা দেয়ার
জন্য। উনি জোর করে হযরত
সখিনাকে হযরত ইমাম হুসাইন
(রাঃ) এর বুক থেকে ছাড়িয়ে
তাঁবুতে নিয়ে গেলেন। আল্লাহ!
আল্লাহ! হযরত ইমাম হুসাইন
(রাঃ) ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গী
সাথীদের লাশ কারবালার
ময়দানে পড়ে রইলো। ইয়াজিদী
বাহিনী তাদের লোকদের
লাশগুলো খুঁজে খুঁজে দাফন করলো
। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)
ও আহলে বায়তের লাশ যেভাবে
ছিল, সে ভাবেই পড়ে রইল ।
আল্লাহ! আল্লাহ! এরা এক রাত
সেখানে অবস্থান করলো । পরের
দিন তাদের চলে যাওয়ার কথা ।
ইয়াযীদী বাহিনীরা, যারা
ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মনে
করেছিল তারা বিজয়ী হয়েছে,
বাস্তবে তাদের এমন পরাজয়ই
হয়েছে যা আর কারো হয়নি। যাক,
যখন তারা শুয়ে পড়ল, হযরত
সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) মুখে পর্দা
ফেলে তাঁবু থেকে পুনরায় বের
হলেন। দেখলেন, হযরত
ফাতিমাতুয যাহরা (রাঃ) এর
বাগানের জান্নাতী ফুল
কারবালার প্রান্তরে পড়ে
রয়েছেন। নবী পাক (ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নয়নের
মণি চকমক করছে। হযরত যয়নাব
(রাঃ) এক পলক সকল প্রিয়জনকে
দেখলেন। ছবর ও ধৈর্যে অটল
থাকা সত্ত্বেও অঝোরে কাঁদতে
লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে এক এক
জনকে দেখে দেখে শেষে
ভাইয়ের দেহ মুবারকের পাশে
আসলেন এবং বসে পড়ে বললেন,
‘ওগো আমার ভাইয়া ! আমি
অসহায়, অপারগ, ভিন-দেশের
মুসাফির। মদীনা মুনাওওয়ারা
অনেক দূর। আমি কিভাবে ওখানে
তোমার খবর পৌঁছাবো? আমি
কিভাবে তোমার দাফন করবো?’
আহ! হযরত ফাতেমাতুয যুহরা
(রাঃ) এর কলিজার টুকরা, নবী
করিম (সঃ) এর আদরের দৌহিত্র
কারবালার প্রান্তরে
বেওয়ারীশের মত পড়ে রইল ।
হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ)
মদীনার দিকে মুখ করে ক্রন্দনরত
অবস্থায় হাত তুলে বলতে
লাগলেন,
ইয়া রসূলাল্লাহ (ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার
দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন
(রাঃ) কাফন ও দাফন বিহীন
রক্তে রঞ্জিত অবস্থায় পড়ে
রয়েছেন।
আর এদিকে রুগ্ন হযরত যাইনুল
আবিদীন (রাঃ) হাত তুলে
বলছেন-
ﻟﻠﻌﺎﻟـﻤﻴﻦ - ﺍﺩﺭﻛﻨﻰ ﺯﻳﻦ ﺍﻟﻌﺎﺑﺪﻳﻦ ﻳﺎﺭﺣﻤﺔ
ইয়া রহমতাল্লিল আলামীন!
আদরিকী যাইনাল আবিদীন’
অর্থাৎ ‘হে রহমাতুল্লিল
আলামীন (ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম) ! আমার উপর রহম
করুন।’
আল্লাহ্ ! আল্লাহ ! এভাবে
রাত্রি অতিবাহিত করলেন।
উলামায়ে কিরাম লিখেছেন যে,
‘হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর
শাহাদাতের সময় সূর্যগ্রহণ
হয়েছিল, আসমান ঘোর অন্ধকার
হয়ে গিয়েছিল, ফলে দিনে
তারকারাজি দৃষ্টিগোচর
হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আকাশ
কালো থেকে লাল বর্ণে পরিণত
হয়েছিল এবং আসমান থেকে রক্ত
বর্ষিত হয়েছিল। সাতদিন পর্যন্ত
এ রক্ত বর্ষণ অব্যাহত ছিল। সমস্ত
ঘর বাড়ির দেয়াল রক্তে লাল
হয়ে গিয়েছিল এবং যেসব
কাপড়ের উপর রক্ত পতিত
হয়েছিল, সেসব কাপড় ছিড়ে
টুকরো টুকরো হওয়ার পরও সেই
রক্তের লালিমা যায়নি। যমীনও
কান্নাকাটি করেছিল। বায়তুল
মুকাদ্দাসে যে পাথরটা উঠানো
হতো, সেই পাথরের নিচ থেকে
তাজা রক্ত বের হতো। পানি
ভর্তি কলস রক্তে লাল হয়ে
গিয়েছিল। ইয়াযীদী বাহিনীরা
যখন উট যবেহ করেছিল তখন সে
উটের ভিতর থেকে রক্তের
পরিবর্তে আগুনের লেলিহান
শিখা বের হয়েছিল। জিনদের
মধ্যেও শোক-বেদনা ছড়িয়ে
পড়েছিল। এক অদ্ভুত ও বিস্ময়কর
অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক
দূর্লভ, লোমহর্ষক ঘটনার কথা
আমরা শুনেছি। কিন্তু হযরত ইমাম
হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের
ঘটনা অতুলনীয় । এর নকশা
চোখের সামনে ভেসে উঠলে মন-
প্রাণ শিউরে ওঠে।
তথ্যসূত্র
কারবালা প্রান্তরে(লেখকঃ
খতিবে পাকিস্তান হযরত
মাওলানা মুহাম্মাদ শফী ওকাড়বী।
(সমাপ্ত)।
Comments
Post a Comment